কিনে আনলাম আমার ছোটবেলার শব্দ ব্রহ্ম যন্ত্র l
শব্দই ব্রহ্ম l আর ব্রহ্ম সদা আনন্দময়, তাকে এই চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা যায় না, অনুভব করতে হয় l ছোটো থেকেই শুনতাম এসব কথা বড়দের মুখে l মাথায় কিছুই ঢুকতো না যদিও l কিন্তু এই রেডিও নামক বস্তটি আমাকে প্রথম এসব কথার সত্যতা যেন প্ৰমাণ করিয়েছিল l কেননা এই অদ্ভুত যন্ত্রটা থেকেই বেড়িয়ে আসতো নানান মধুর শব্দ, যা শুনে আমার শিশু মন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো l কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারতাম না এই যন্ত্রটির ভিতরে বসে কারা এমন করে কথা বলছে, গান গাইছে, শব্দ করছে ! যখন আশপাশে বড়রা থাকতো না, তখন এই যন্ত্রটি হাতের নাগালে পেলে সাধ্যমতো নাড়িয়ে ছাড়িয়ে চাপড়িয়ে দেখেছি কতো! কিন্তু তবুও রহস্যের সমাধান হয় নি l তখন আমি মনে মনে নিশ্চিত হয়েছিলাম ঠিকই,শব্দই ব্রহ্ম,তাই তাকে আমি খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তা শুনে আমি ভীষণ ভাবে আনন্দিত হচ্ছি l সেদিন থেকেই এটি আমার কাছে হয়ে উঠলো শব্দ ব্রহ্ম যন্ত্র l
আমি দেখতাম কেবল আমি নই ; খালি মেঝেতে অথবা মাদুর বিছিয়ে,রাস্তা-ঘাটে, বাড়ির উঠানে, রোয়াকে, দোকানে-বাজারে,সেলুনে সর্বত্রই মানুষ সকাল থেকে এই রেডিওর শব্দে সরগরম থাকতো l সে মহালয়ার পুণ্য প্রভাতই হোক কিম্বা ছুটির দিনের রবিবারের অলস দুপুর, অথবা লোডশেডিংয়ের অন্ধকারেও, আবার পাড়া ঘুমানি রাতে পূর্ণিমার চাঁদে আলোকিত খোলা ছাদেও – রেডিও চালিয়ে সকলেই শুনে চলেছেন খবর থেকে বিনোদন,খেলা থেকে রাজনীতি সবকিছুই l কতো রকমের শব্দ, আর সে সব শব্দের কতো রকমের সুর, ছন্দ,তাল,লয়,ভাষা! এসবের সাথেই সকলের আবেগ,আনন্দ, রোমাঞ্চ মিলে মিশে যেন একাকার হয়ে যেত l
বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারতাম এই রেডিও আমার চিন্তা শক্তিকে বহু গুণ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করছে। চোখে দেখে যেকোনো ঘটনাকে খুব সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু কানে শুনে কোন ঘটনার প্রকৃতি নির্ধারণ করাটা বেশ কঠিন l যেমন যেমন শোনা, তেমন তেমন বোঝা, সেই মতো মুহূর্তের মধ্যে চিন্তা আর ভাবনা দিয়ে সে গুলোকে মনের আঙিনায় ছবির মতো করে এঁকে চলা ! তাই তো মনও হয়ে উঠছে আরো অনুভবী, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে শব্দ গুলো ধরতে বুঝতে চাইলেই চিন্তাশক্তির বিকাশ হচ্ছে আপনা হতেই! কল্পনা শক্তি প্রবল হচ্ছে অন্তরে! রেডিও এমন একটা শ্রবণ যন্ত্র যার মাধ্যমে বেদের মতো কেবল শ্রুতি দিয়ে গোটা বিশ্ব ব্রম্হান্ডের সাথে আমার পরিচয় ঘটে গেলো l গোটা দেশের মানুষের মনের ভাবের সাথে আমার মনের ভাবের আদান প্রদান ঘটলো রেডিওর দৌলতেই l আমার দেশের বহু ভাষাভাষীর, বহু ধর্মের, বহু জাতির মানুষ যে আসলে ভারতীয় হিসাবে এক এবং অভেদ এই সম্পর্কে একটা সম্মক ধারণা জন্মে গেলো আমার রেডিওর অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে l এইভাবেই ভারতীয় সংস্কৃতি রেডিওর হাত ধরে শ্রুতির মাধ্যমে ব্রহ্ম স্বরূপ পৌঁছে গেছিল আমার প্রাণে, মর্মে, মরমে l
আদি গণযোগাযোগের মাধ্যম এই রেডিওর সাথে বাঙালির আত্মিক সম্পর্কটি ছিলো জন্মলগ্নের l যদিও বিরহ মধুর সেই কাহিনী l রেডিওর আবিষ্কর্তা হাসাবে আমরা ‘মার্কোনি’র নাম কমবেশি অনেকেই জানি। কিন্তু আসলে যে বিখ্যাত এক বাঙালি বিজ্ঞানী ছিলেন রেডিওর প্রকৃত জনক, ‘আচার্য শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসু’, তা কি আমরা জানি? কিভাবে?তিনিই প্রথম “মার্কারী কোহেরার” আবিষ্কার করেছিলেন, যা হোলো একটি রেডিও তরঙ্গ রিসিভার l ১৮৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় যখন পদার্থবিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় তরঙ্গগুলি অধ্যয়নের সাথে তার ব্যবহারিক প্রয়োগেরও কৌশল চালাচ্ছিলেন , তখন মার্কোনি সেই তরঙ্গ রিসিভার কোহেরার অবলম্বন করেই তাকে যথাযথ ব্যবহার করেছিলেন দীর্ঘ দূরত্বের যোগাযোগের প্রথম যন্ত্র হিসাবে একটি অপারেশনাল দ্বিমুখী রেডিও তৈরি করতে l কিন্তু সেই শ্রেয় কোথাও বাঙালি বিজ্ঞানী পাননি।
বর্তমান যুগে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ্যা নিজের ডালপালা এমন তীব্র গতিতে বিস্তার করাতে যোগাযোগ মাধ্যম হিসাবে সব থেকে বেশি অবহেলিত হয়েছে এই রেডিও l আজকের যুগে বাড়িতে বসে রেডিও শোনা নাকি পুরাতন পন্থা।
বিবর্তনের জেরে পৃথিবী নিয়ত বদলে যাচ্ছে l তাই নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বর্তমানে আজ মোবাইল ফোনেও ধরা দিয়েছে রেডিও অ্যাপসের মাধ্যমে l নিজেকে সে বিকশিত করে তুলেছে আধুনিক ঢঙে, নতুন বৈচিত্রময় আদলে l অথচ অন্তর জুড়ে তার সেই পুরাতন আভিজাত্য, রুচি, স্বাদ, সৌন্দর্য্য, সুগন্ধ সংস্কৃতি কিচ্ছুটি হারায় নি যেন l আজও রেডিও নামক এই যন্ত্র দিয়েই শোনা যায় অসমুদ্র হিমাচলের আনন্দময় শব্দ ব্রহ্ম l
শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে তাই রেডিও শোনার পুরোনো অভ্যাসটা আবার নতুন করে গড়ে তুলবোই এই নতুন শব্দ ব্রহ্ম যন্ত্রটির সাথে ll