(১)
সকালে সৃষ্টির কাছে হঠাৎ ফোন এলো। অপরিচিত নম্বর দেখে একটু ভ্রু কুঁচকে গেলো। তারপর ফোন টা ধরে,
” কে বলছেন?”
“আমি অগ্নিভ, চিনতে পারছ?”
“হ্যাঁ, সেই তো গতমাসে….তুমি হঠাৎ?”
“লক ডাউন হলো তো, অসুবিধা হচ্ছে কোনো?”
“হ্যাঁ, এমাসের বাড়ি ভাড়া দেওয়া এখনও বাকি, তুমি কেমন আছো, আমাদের আর অসুবিধা, জানোই তো সব, নতুন করে কি বলবো, যাকগে বলো ?”
“আগে বলো ছেলে কেমন আছে ?”
“ঠিকঠাক, কিন্তু তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো?”
“ছেলের স্কুলের ফিস দিতেও তো সমস্যা হচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ, বাট তুমি কি বলতে ফোন করেছ বলো তো ?, এখন কিন্তু কাজ বন্ধ।”
“জানি, তোমার অ্যাকাউন্ট নম্বর একটু পাঠাও তো, শোনো লক ডাউন যতদিন থাকবে চিন্তা করতে হবে না, আমি আছি, নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আপাতত জলদি পাঠাও, গুগল পে থাকলে দাও, আর চিন্তা করবে না, ছেলেকে ভালো করে মানুষ করো।আমি রইলাম, রাখছি ফোন টা”।
“ফোন রেখে কিছুক্ষন হতভম্ব অবস্থায় বসে রইলো সৃষ্টি। হাসবে না কাঁদবে সেটা বুঝে উঠতে পারল না, সত্যি বলতে কী একটা অদ্ভুত অনুভুতির মধ্যে বসে রইলো আর ফিরে গেলো নিজের অতীতের কিছু ভাবনায়।।
(২)
২০০৫ সালে কলেজে পড়ার সময় আলাপ রণজয়ের সাথে। ৬ বছর চুটিয়ে প্রেম করে ২০১১ সালে এক মাঘের সন্ধ্যেবেলা এ বাড়িতে বউ হিসাবে এলো সৃষ্টি। মনে এক নতুন আনন্দ, চোখে এক নতুন স্বপ্ন। কিন্তু ভুল ভাঙতে খুব বেশি দিন যায়নি। চার দেওয়ালের আড়ালে রণজয়ের পাশবিক রূপটা ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয় তার সামনে। আমাদের সমাজে বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়না, কারণ বিবাহিত জীবনে একজন মেয়ের ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম আছে সেটাকেই অনেকে গুরুত্ব দিতে চান না। প্রথম প্রথম সংসারের মুখ চেয়ে চুপ করে ছিল সৃষ্টি। ২০১৬ তে ওর কোল আলো করে এলো অনুভব, ওদের আদরের একমাত্র সন্তান। কিন্তু তাতেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। একদিকে প্রতিবাদ করলে অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে চলেছে, অপরদিকে রণজয় নিজের অফিসে সেক্রেটারির সাথে এক নতুন খেলায় মত্ত হয়েছে। এসব দেখে ঘেন্নায় অবশেষে ২ বছরের ছোট্ট অনুভব কে নিয়ে ঘর ছাড়লো সৃষ্টি। কাজ নিল এক বিউটি পার্লারে। একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। শুরু হলো নতুন ভাবে পথ চলা, নতুন ভাবে গড়ে ওঠা। ছেলেকে মানুষ করতে হবে, অনেক লড়াই যে বাকি।।
(৩)
সেক্টর ফাইভের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদস্থ পোস্টে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার অগ্নিভ। জীবন থেকে ভালোবাসা হারিয়েছে কিছু মাস আগেই। কলেজ জীবনের শুরু থেকেই ভালোবাসতো সুপ্রভাকে, যদিও সুপ্রভা না তো কখনো তার ভালোবাসা বুঝেছে, না তো বন্ধুর বাইরে তাকে কিছু ভেবেছে। যদিও তাতে অগ্নিভর কিছু যায় আসেনা, সে মন দিয়ে একটানা ভালোবেসে চলেছিল। এক অফিসে কাজের সুবাদে একসাথে যাওয়া আসা, গল্প গুজব সবই চলতো। অগ্নিভর মনে একটা ধারণা ছিল যে এতটা ভালো বন্ধু , সম্ভবত বোঝে, তাই একদিন ভয়ে ভয়ে নিজের অনুভূতি বলেই দিয়েছিল। বিশ্বাস ছিল সুপ্রভা যখন এতটা ভরসা করে ওর আবেগ বুঝবে।
কিন্তু উল্টো দিক থেকে যে মেসেজ টা এসেছিল সেটা এক লহমায় অগ্নিভর সব স্বপ্ন আবেগ অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছিল,
“যদি আমার থেকে বন্ধুর বাইরে কিছু চাস, তাহলে আমার জীবন থেকে সরে যা, আমি চাইনা তুই বন্ধুর বাইরে কিছু ভাবিস বা আশা করিস।”
সুপ্রভার বিয়ের কার্ড টা হঠাৎ করে একদিন পায় অগ্নিভ, তার সাথে টানা ৩ দিনের নিমন্ত্রণ। গেছিলো, তবে পরবর্তীকালে নিজের জীবন থেকে ভালোবাসা কে হারিয়ে ফেলেছিল। আশা, বিশ্বাস, ভরসা তিনটিই চলে গেছিলো। সুপ্রভার জায়গায় কাউকে বসাতে পারবো না – এই চিন্তা বারবার কুরে কুরে খেয়েছিল তাকে। অবশেষে নিজের জীবনের এতটা কষ্ট, প্রতিটা রাতে শুতে যাওয়ার আগে সুপ্রভা কে অন্য কারুর ঘরণী হিসাবে ভাবার চিন্তায় মাথা ছিড়ে যাওয়া, নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে উপস্থিত হলো এক অন্য জগতে। মনে রইলো এই বিশ্বাস,
“ভালবাসা থাকলে আমার ভালোবাসাও পূর্ণতা পেত, ভালোবাসা নেইও, আবার আছে, আছে…”।।
(৪)
কোভিড পরিস্থিতিতে লক ডাউনের জন্যে সৃষ্টির বিউটি পার্লারের চাকরি টা চলে যায়। এই সময় রণজয় মুখ ফিরিয়ে ছিল। প্রবল আত্মসম্মান নিয়ে থাকা সৃষ্টি তার বরের ( প্রাক্তন) দিকে ফিরেও তাকায়নি সাহায্যের জন্যে। এই সময় দীর্ঘদিন বন্ধু বান্ধবী দের থেকে টাকা ধার করে সৃষ্টি কোনরকম ভাবে নিজের ও ছেলের পেট চালায়। একটা সময়ের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। কিন্তু তখন আগে ধার মেটাতে হবে। তবে তো ভবিষ্যতের চিন্তা। এক বান্ধবী তাকে বলে কাজ আছে, কিন্তু খুব গোপন, এমন কাজ যেখানে গোপনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু টাকা আছে, কর্পোরেট কলগার্ল। দাঁতে দাঁত চেপে সৃষ্টি শুরু করে নতুন জীবন। সেই কাজেই একদিন আলাপ হয় অগ্নিভর সাথে। ততদিনে সুপ্রভা কে ভুলতে নিজের জীবনের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে অগ্নিভ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো পেশাদার কাজে এসেও দুজনে খুব বন্ধু হয়ে যায় দুজনের। অগ্নিভ ছেলেটি প্রচণ্ড ভালো মনের মানুষ। যার কাছে সম্পর্কটি শুধু সার্ভিস প্রোভাইডার ও ক্লায়েন্ট এর মধ্যে সম্পর্ক না, বন্ধুত্বের। আসলে অগ্নিভ তো স্বভাব দোষে এই জগতে আসেনি, এসেছে ভালোবাসা হারিয়ে চোখের জল শুকিয়ে। তাই সহজেই তার তরফ থেকে স্নেহের ও ভালোবাসার অভাব ছিলনা। দীর্ঘদিন ভালোবাসা থেকে বিচ্যুত হয়ে ভালোবাসার অভাবে পাগল সৃষ্টি সহজেই তার ভালোবাসাতে ধরা দেয়। শুরু হয় এক অনুভূতি সম্পন্ন বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক। সৃষ্টি দেখেছিল যে অগ্নিভ একজন সেই রকম মানুষ নন যিনি কাজ মিটে গেলে ছুড়ে ফেলে দেবেন, যেমন বাকি ৫ জন এই লাইনে হয়, বরং সে এমন কেয়ারিং এবং দায়িত্ববান যেটা দেখে দিনের পর দিন সৃষ্টি তার প্রতি দুর্বল হতে থাকে। বেচারা সুপ্রভা, জানতেও কখনো পারলনা কি ভালোটাই না বাসত অগ্নিভ, এই অনুভূতিটাই মিস করে গেলো, সত্যিই জীবন বড়ো রহস্যময়।
অগ্নিভ সৃষ্টির ফোন নম্বর টি নিজের কাছে সেভ করে রেখেছিল। যোগাযোগ রাখত, এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব তৈরি হয় দুজনের মধ্যে যেটা পূর্ণতা লাভ করে করোনা পরিস্থিতিতে।
(৫)
দ্বিতীয় দফায় করোনার ঢেউ আসতে আবার লকডাউন শুরু হলো। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। এই ধরনের কাজে নিরাপত্তা জনিত কারণে একদমই কাজ বন্ধ। অতএব আবার পেটে টান। বাড়িভাড়া দেওয়া বাকি, ছেলের স্কুলের মাইনে দেওয়া বাকি। কিভাবে কি করবে সেটাই ভাবছিল সৃষ্টি। হঠাৎ অগ্নিভর ফোন এবং সৃষ্টি এতক্ষণ আবোল তাবোল পুরনো কথাই ভাবছিল। কিভাবে জীবন পরিবর্তিত হলো এবং ভাবাও যায়নি হঠাৎ অগ্নিভ ফোন করে নিজে পাশে দাঁড়াবে। সত্যি এরকম ও হয়, ভাবছিল সৃষ্টি। সম্বিত ফিরল একটা WhatsApp মেসেজে।
“দাও, জলদি গুগল পে নম্বর।”
” নাও, এই নম্বর ৯৮***।”
“একটু চেক করে নাও, কিছুটা অর্থ পাঠালাম।”
“ওই, তুমি কি পাগল, মানে এতটা টাকা দিতে কে বললো।”
“আরে বাবা তুমি কি আমার নিজের লোক না, নাকি?”
“হ্যাঁ, কিন্তু সেই বলে এতটা অর্থ আমার জন্যে খরচ করাও তোমার উচিত না , আমি তোমার কে বলো?”
“ভালোবাসার মানুষটা কখনো জানলো না যে আমি ওকে অতটা ভালোবাসি, কখনো জানার চেষ্টা করলো না, কখনো বুঝতে চাইলনা, সেখানে তুমি অন্তত আমায় বোঝো, অন্তত বোঝার চেষ্টা করো, অন্তত বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দাও না, এটা অনেক না ?”
“জানো, ওবাড়ি থেকে চলে আসার পর কখনো ভাবতে পারিনি যে কেউ এতটা বুঝবে বা এতটা পাশে থাকবে, আমাদের যা জীবন, মানুষজন নোংরা ভাবে, সেখানে অনেকদিন বাদে জীবনের উপর বিশ্বাস জাগছে, মনে হচ্ছে , না, জীবনে বিশ্বাস সম্পূর্ণ হারাতে নেই।”
“আসলে আমাদের সমাজে যেটা প্রচলিত বা যেটা সবসময় বোঝানো হয় সেটাই সত্য না, যে উচ্চ শ্রেণী তোমায় নোংরা বলে, মনে রাখবে সেই উচ্চ শ্রেণীর মানুষই বাড়িতে গৃহিণী রেখে এসে গোপনে তোমার সাহচর্য লাভ করে আর বাইরে তোমাদের নামে নোংরা তকমা দেয়, তাহলে নোংরা কারা নিজেই বল?”
সৃষ্টির জীবনে মেঘের ঘনঘটা র মধ্যে আজ একফালি রোদ্দুর হঠাৎ করে এসে পড়লো, অনেকদিন বাদে একটু রোদ্দুর দেখা যাচ্ছে, না বিশ্বাস বলে কিছু নেই কে বললো, জীবনে আশা হারাতে নেই, ভালোবাসার মৃত্যু নেই, সেটা শুধু সময়ের সাথে রূপান্তরিত হয়।
বাড়ি ভাড়া টা সৃষ্টি মিটিয়ে এলো, কিছু বাজার ও করে আনলো, স্কুলের মাইনে অনলাইনে দেওয়া হয়ে গেছে। সন্ধ্যেবেলা ছাদে এসেছে, দূরে কোথাও থেকে গান ভেসে আসছে মৃদু স্বরে,
“চাঁদের আলোয় রাত যায় যে ভরে, তাহার মত তুমি কর না কেন ও গো ধন্য মোরে।
যেমন করে নীড়ে একটি পাখি, সাথীরে কাছে তার নেয় গো ডাকি
যেমন করে সে ভালবাসে, কই তাহার মত তুমি আমায় কভুও ভালবাসো না তো।।”
অনেকদিন বাদে নিজে থেকে দরকার ছাড়া কাউকে মেসেজ করতে ইচ্ছা হচ্ছে সৃষ্টির, অগ্নিভর নম্বরে একটা মেসেজ লিখেও ভাবছে পাঠাবে কিনা,
বিরক্তি ভরে যখন মেসেজ পড়েও রিপ্লাই দেওয়া হয় না,
অথবা ফোন এলে চুপচাপ ইগনোর করে যাওয়া হয়,
তখন জানতেও পারা যায় না,
ওই মেসেজের একটা রিপ্লাই বা ফোনে একটু বার্তালাপ,
বাঁচিয়ে দিত একটা মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মনটাকে,
নিয়ে আসত একটু দখিনা বাতাস…
ভরিয়ে দিত মনোমুগ্ধকর অনুভূতিতে, যেনো বসন্তের সুবাস…
প্রেমেরও গন্ধ আছে,
তোমার অনুভূতির করোনা হওয়ার ফলে তুমি সেটা পাও না।।
…………….. সুমন কুমার দত্ত