“ ——- এই যে, প্রকাশ পাড়ুকোনের নাতি, অনেক খেলে ফেলেছো, এবার চাবিটা দিয়ে যাও, আমাদেরও তাড়া আছে।” নেটের ওপাশ থেকে উড়ে আসা শাটলককটা আকাশেই থেকে গেল। এমন কর্কশ গলার আওয়াজ শুনলে চোখ স্থির রাখা যায় নাকি? রাগে গা-টা রি রি করে উঠল। সবেমাত্র ১০-৯ এর লিড নিয়েছিলাম আমরা, আবার ওদের পয়েন্ট! যাইহোক, পকেট হাতড়ে চাবির গোছাটা বের করে একদৌড়ে রেলিঙের ধারে এসে দিলুদার হাতে দিতেই, সে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “ তাড়াতাড়ি চলে আয়, আসর বসবে আজ।” তখন অবশ্য ম্যাচ জেতাটা অনেক বেশি জরুরি ছিল আমার কাছে, তাই আসর নামক শব্দটা কানে ঢুকলেও ঘিলু অবধি পৌঁছায় নি। এক দৌড়ে আবার কোর্টে ফিরে এলাম। যদিও শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা আর জেতা হয়ে ওঠে নি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে মেসের দিকে পা বাড়াতেই “আসর” নামক শব্দটা ঘিলুর শেষ দরজা খুলে টুক করে অন্দরে প্রবেশ করল। “আসর! কিসের আসর? এরা আবার গান-বাজনাও করে নাকি?” আসলে আমার মেসে এ মাসের শুরুতেই একটা ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আমার আগের তিনজন রুমমেটই ইউনিভার্সিটির হস্টেল পেয়ে মেস ছেড়ে চলে গিয়েছে গতমাসে। আর এ মাসের শুরুতেই মেসে তথা আমার জীবনে আবির্ভাব হয়েছে তিন দেবতুল্য ব্যক্তিত্বের – দিলুদা, টুলুদা আার সান্টুদা। এই তিন বরেণ্য ব্যক্তির ছোঁয়ায় আমার জীবনে যে শত-সহস্র অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়েছিল, আজকের গল্প তাদেরই একটি।
তা সে যাই হোক, ঘিলুর ভেতর ‘আসর’ নামক বিষয়টির কাল্পনিক ছবি সহযোগে মেসে প্রবেশ করা মাত্রই দেখতে পেলাম আমার সেই তিন গুরুদেব ছাড়াও চতুর্থ আরেকজন অদৃষ্টপূর্ব সম্মানীয় ব্যক্তিও রয়েছেন সেখানে। দিলুদা মেঝেতে একাধিক খবরের কাগজ পাততে ব্যস্ত। টুলুদা সরষের তেল সহযোগে অঙ্কুরিত ছোলা ও পেঁয়াজ মাখছে আর সান্টুদা ছুরি দিয়ে কুঁচি কুঁচি করে কাঁচা লঙ্কা কেটে সেই মিশ্রণের টেম্পারমেন্ট বাড়াতে সাহায্য করছে। চতুর্থ ব্যক্তি যে কিনা একটা প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ থেকে এ্যাত্ত পিঁয়াজি একটা থালায় জমা করছিল, আমায় দেখেই হাত বাড়িয়ে বললো, “এই যে কচি, আমি মিঠুদা, জলপাইগুড়িয়ান, তবে বেহালায় থাকি।” কাকতালীয় ভাবে এরা সবাই ছিল আমার মাতৃভূমির বাসিন্দা, আর তাই গার্জেনশিপটা ছিল চরম আকারের। আমি যদিও ‘আসরের’ রহস্যটা ততক্ষণে অনেকটাই সমাধান করে ফেলেছি, তবে অদৃশ্য তরল তখনও কিছুটা কৌতূহল ধরে রেখেছে। বিশেষ কথা না বাড়িয়ে বাথরুমে ( আমাদের জেনারেশন এখনও বাথরুমই বলে, ওয়াশরুম-টুম আমাদের আসে না ) হাত-পা ধুয়ে ফিরে এসে চৌকির ওপর চড়ে বসলাম। ততক্ষণে অদৃশ্য তরল দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এক নয়, একাধিক। তিনটে ছোট শিশি, আর দুটো লম্বা ধরনের বোতল। দিলুদাই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল –
—- দ্যাখ্, কচি, এটা আমার ফেভারিট — ব্যাগ পাইপার। ( সেই প্রথম বিউগল আর স্যাক্সেফোনের সাথে ব্যাগ পাইপারের পার্থক্যটা শিখেছিলাম দিলুদার শিশির বদান্যতায়। ) তারপর টুলুদার পাশে রাখা দ্বিতীয় শিশিটা দেখিয়ে বললো, টুলুর ফেভারিট —— অফিসার্স চয়েস। ( টুলুদাকে কেমন অফিসার অফিসার দেখাচ্ছিল৷ ) মিঠুদার সামনের শিশিটা দেখিয়ে বললো, ওটা রয়াল স্ট্যাগ, মিঠু ওটা ছাড়া খায় না। মিঠুদার দিকে চোখ গেল, ওর মুখে একটা রাজকীয় আভাস দেখতে পেলাম।
—— আর সান্টুদার সামনের ওই বড় বোতল দুটোতে কি আছে?
মৃদু হেসে সান্টুদা বলল আমি হার্ড নিই না, তাই সফট —– এটা কিংফিশার বিয়ার।
—– তুমি অত খাবে কেন? দু বোতল!!
—- আরে কচি, বিয়ারের অ্যালকোহল পার্সেন্টেজ কম হয। ওদের এক শিশি বরাবর আমার দু বোতল।
এরপর যে যার শিশি বোতল গ্লাস নিয়ে ব্যস্ত হতেই আমি বিছানা থেকে ঝুঁকে পড়ে টুক করে একটা গরম পিঁয়াজি তুলে নিলাম হাতে। বেশ একটা মন খুশি করা গন্ধ। সবে কামড় বসাতে যাচ্ছি, হঠাৎ দিলুদার ক্যারক্যারে গলার চিৎকার —— “একদম না। না মানে না। শুধু মুখে আজ তোমাকে চাট ঝাড়তে দিচ্ছি না গুরু।”
— কেন? আমি কি শুধু শুধু বসে দেখব? বলেই পিঁয়াজি বাবাজিকে মুখের ভেতর পুরে ফেললাম। আর কোথায় যায়? অমনি দিলু, টুলু, সান্টু সব দাদা মিলে ধরল আমাকে জাপ্টে। মিঠুদা মুখের ভেতর প্রায় গোটা হাতটা ঢুকিয়ে লালা মিশ্রিত অর্ধেক চিবোনো পিঁয়াজিটা টেনে বার করে ফেলল খবরের কাগজের ওপর।
ওদের হাতের প্যাঁচ থেকে উদ্ধার হতেই চিৎকার করে বললাম, “তাহলে আমাকে ডাকলে কেন? নাটক করছো? দিব্বি তো ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম!” আমারও তখন মাথা গরম।
—– ওরে কচি, রাগ করে না, আসলে আজকে একটা প্ল্যান আছে, সেটা একটু অন্যরকম।
—– কি প্ল্যান, শুনি?
—– বলছি কি, তুই তো কখনো এসব চেখে দেখিস নি, তাই বলছি পিঁয়াজি তোকে একটার জায়গায় দুটো দেওয়া হবে, কিন্তু সবার আবদারে আজকে একটু সুরা রসও সেবন করতে হবে, ভাই আমার।
—- সে আবার কি? এসব আমি কখনো খাইনি!
—- অদ্ভুত! আরে, আমরা কি জন্ম থেকেই খাচ্ছি? আর তাছাড়া আজকে সবার আবদার।
হঠাৎ মিঠুদা ওপাশের খাটের তলা থেকে আরেকটা গ্লাস বার করে বললো, “দ্যাখ্, ভাই, সবার আবদার আর আমি আজকেই প্রথম তোদের এখানে তাই, সবার রিকোয়েস্ট, বেশি নয় দুই ছিপি করে, ব্যাস।”
এই বলেই মিঠুদা তার রয়াল স্ট্যাগ-এর বোতল থেকে দু ছিপি ঢেলে দিল নতুন গ্লাসে।
এরপর একে একে দিলুদার ব্যাগ পাইপার আর টুলুদার অফিসার চয়েসের দু ছিপি মিলে মোট ছয় ছিপি তরল জমা হল গ্লাসে।
হঠাৎ সান্টুদা বলে উঠল, “আমার তো লো পার্সেন্টেজ, তাই তোর গ্লাসের বাকিটা আমিই ভরে দিচ্ছি।” বলেই গ্লাসের খালি অংশটা ভরে দিল ফেনাযুক্ত বিয়ার দিয়ে।
দিলুদা এবার নিজে হাতে গ্লাসটা তুলে দিল আমার হাতে। আর টুলুদা দিল দু’দুটো কড়কড়ে পিঁয়াজি।
নাকের কাছে গ্লাসটা নিতেই একটা ঝাঁঝালো গন্ধে গা-টা গুলিয়ে উঠলো।
—– না, না, না, শুঁকতে নেই কচি, ঢক করে কিছুটা গিলে নিয়েই একটা পিঁয়াজি মেরে দে। তবে তার আগে সবার সাথে গ্লাসটা তুলে সবার সাথে একটু চিয়ার্স করে নে।
আমিও বাধ্য ছেলের মতই গ্লাস তুলে চিয়ার্স করে দু’ঢোক তৎক্ষনাৎ মেরে একটা পিঁয়াজি পুরে দিলুম মুখে। গলায় তুমুল শোরগোল তুলে জ্বলতে জ্বলতে সেই তরল রস প্রবেশ করলো আমার পাকস্থলীতে। একটু ধৈর্য্য ধরে রইলাম। তারপর তাড়াতাড়ি পিঁয়াজিটাও অর্ধ চর্বিত অবস্থাতেই পাস করে দিলাম ইসোফেগাসের মধ্যে দিয়ে। তাতে জ্বালা কিছুটা জুড়ালো বটে। ধাতস্থ হচ্ছিলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ বাপ-মায়ের ঝাঁটা-লাঠি তোলা কাল্পনিক ক্ষেপচুরিয়াস মুখ গুলো কোথা থেকে ভেসে উঠলো কে জানে! ভয়ে তাড়াতাড়ি বাকি তরলও ঢেলে দিলাম গলায়। ওহ্, অসহ্য! হাতে থাকা দ্বিতীয় পিঁয়াজিটাও মুখে ঠেসেছি ততক্ষণে।
হঠাৎ শুনলাম দিলুদা স্টিরিও সিস্টেমে ক্যাসেট পুরেছে, —– নদীয়া সে দরিয়া, দরিয়া সে সাগর, সাগর সে গ্যেহরা জাম।
ব্যস তারপর কতক্ষণ যে ফ্যালফ্যাল করে ওদের আসরস্থলের দিকে তাকিয়ে বসেছিলাম, মনে নেই। সম্বিত ফিরলো গলার কাছে কিছু একটা ঠেলা দিয়ে ওঠায়। বেশ বুঝলাম কিছু একটা ওপর দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তাই দেরি না করে চৌকির ধারে সরে এসে চপ্পলে পা গলাতে যেতেই বেশ বুঝতে পারলাম, হচ্ছে না। কিছুতেই হচ্ছে না। হয় আঙুল গুলো অন্যদিকে সরে যাচ্ছে নয়তো চপ্পল গুলো। এদিকে দিলুদা-টুলুদা-সান্টুদা-মিঠুদা তখন মদমত্ত। যে যার নিজের মতো করে কি যেন একটা হিন্দি গানের সাথে গলা মেলাতে ব্যস্ত। আমার কিন্তু তখন নষ্ট করার মত সময় নেই। বেশি দেরি হলে আসরের মধ্যিখানটা ছারখার হয়ে যেতে পারে মুহূর্তে। বার চারেক হেঁচকির মত উঠে কিছু জিনিসপত্র গলা ছুঁয়ে আবার নেমে গেছে বটে, আর বেশিক্ষণ তাদের আমি আটকে রাখতে পারব না। বাধ্য হয়েই চপ্পলের আশা ছেড়ে খালি পায়েই চটপট রওনা দিলাম বাথরুমের উদ্দেশ্যে। এদিকে মাঝে যে চৌকাঠ ডিঙিয়ে উঠোন, সেটা গোল মেরে দিয়েছি কখন। বুঝে ওঠার আগেই চিৎপটাং উঠোনে। মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছুটা টক-জল ছিটকে বেরলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হঠাৎ আমি অতি সাবধানী হয়ে উঠে সন্দিগ্ধ চোখে আশপাশটা দেখে নিলাম। নাহ্, কারো নজরে আসেনি। এবার উঠেই সোজা ছুটলাম বাথরুমে। কলের পার খুব পেছল, সেটা পেরিয়ে যেতে হবে বাথরুমে। এবার আমি যথেষ্ট অভিজ্ঞ। পা টিপে টিপে পৌঁছে গেলাম বাথরুমে। পেটের ভেতর তখন উথাল-পাথাল হচ্ছে। বাঁদিকের চৌবাচ্চার পারটা ধরে ঝুঁকে পড়লাম সামনের ড্রেনের দিকে।……… কিন্তু এ কি? কই, কিছুই তো বের হচ্ছে না! আাবার চেষ্টা করলাম, উহু! একবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার চেষ্টা করলাম। পেটের ভিতর তো সব দলা পাকিয়ে উঠছে, গলার কাছেও আসছে, কিন্তু মুখ দিয়ে যে কিছুতেই বের হচ্ছে না! কি করি? পেট গোলাচ্ছে, ওয়াক আসছে, অথচ মুখ ড্রাই! অদ্ভুত ব্যাপার! বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই। মগে করে কানে-চোখে-মুখে জল দিলাম। কিন্তু ভেতরে যে দলাই মালাই চলছে! কি করি আমি? কতক্ষণ যে এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, খেয়াল নেই, চমকে উঠলাম টুলুদার বকা খেয়ে।
—– কি করিস এখানে?
—– বমি বমি পাচ্ছে, কিন্তু হচ্ছে না! আমার কাচুমাচু মুখ।
—– বাইরে বের হ, আমি দেখছি।
আমি বের হতেই তিনি ভেতরে ঢুকে দরাম করে মুখের ওপর দরজাটা দিলেন বন্ধ করে! যা ব্বাবা! একটু পরেই জলের আওয়াজ, যাক্, ছোট যাত্রা, শেষ হবে এক্ষুনি। যা হোক, আমার তখন অন্যকে নিয়ে ভাবার মত সময় নেই, নিজেকে নিয়েই খুব ব্যস্ত। হঠাৎ টুলুদা বাইরে বেরিয়ে এসে বললো, “ ভেতরে ঢুকে সামনে ঝুঁকে গলার ভেতর একটা আঙুল পুরে দে, ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি অমনি বাধ্য ছেলের মত ভেতরে গিয়ে চেষ্টা করতেই ব্যস ——– গলগল —— গলগল ——– গলগল। ——- শান্তি!
বেশ কিছুটা সময় ঝুঁকেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ বুঝলাম টুলুদারও লব্ধ জ্ঞান। আর কিছু বাকি নেই বুঝে সোজা হয়ে জল ঢাললাম কয়েক মগ। তারপর কানে-চোখে-মুখে আবার জল দিয়ে বাইরে বেরোতেই বুঝলাম পৃথিবী দোদুল্যমান। আর আমি ও আমার সর্বস্ব এই দোদুল্যমান জগতে বনবন্ করে ঘুরছে। বহু কষ্টে দেয়াল ধরে ধরে দরজা অবধি পৌঁছেছিলাম, কিন্তু বাধ সাধলে সেই চৌকাঠ!!!!!
পরের দিন সকালে আবার আমার আমিকে রিকভার করলাম চৌকিতে। তখন যদিও আগের দিনের কথা ভেবে বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিল। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম সব নর্মাল। এ কেবল আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, এতে কারো কিছুই যায় আসে নি। তবে মাথার পেছনের আলুটা আরও বহুদিন পরেও রাতের বিছানায় আমার সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার স্মৃতি বহন করেছিল।।