মামাবাড়ি ও কমলিকা

একটা আলাদাই মজা, এমন একটা জায়গা যেখানে যেতে পারলে সব ক্লান্তির অবসান ঘটতো,এমন একটা জায়গা যেখানে যাওয়ার জন্য মন ছটফট্ করতো। সারাটাবছর অপেক্ষায় থাকা কবে জামাইষষ্ঠী আসবে,কবে গ্রীষ্মের ছুটি আসবে বা কবে ফাইনাল পরীক্ষাটা শেষ হবে কবে যাবো সেখানে, হ্যাঁ এরকম অপেক্ষা করার নামই “মামাবাড়ি”।
মামাবাড়িতে আমাদের এক আলাদাই স্থান। গোটা পাড়ার লোক আমাদেরকে আমাদের মায়ের পরিচয়ে চেনে,খুব গর্ব হয় তখন। এমনিতে তো সবজায়গায় বাবাদের পরিচয় প্রয়োজন হয় কিন্তু পৃথিবীতে হয়ত মামাবাড়িই একমাত্র জায়গা যেখানে মায়ের পরিচয়ে চেনে আমাদের সবাই।
-কিন্তু একবার চিন্তা করুন তো যার মা নেই তাকে মামাবাড়িতে কি পরিচয়ে চিনবে?

বছর এগারোর কমলিকা। জন্মের ঠিক কয়েকমাস পরই মা মারা যায় তার, ছোটোথেকেই বেশিরভাগ লোকের গলগ্রহে বড় হয়েছে ও । ওকে দেখে রাখার কেউই ছিলো না। পিসি, কাকা,জ্যেঠারা সবসময়ই ওকে এড়িয়ে চলতো । সেই সকালবেলা কোনোরকম তার বাবা কিছু একটা রান্না করে কাজে চলে যাওয়ার সময় স্কুলে পৌঁছে দিতো, স্কুল থেকে একাই বাড়ি ফিরে আসতো। সারাটাদিন কেটে যাওয়ার পর ছোট্ট ওই একরত্তি মেয়েটি তার বাবার হদিশ পায়। এভাবেই কেটে যায় তাদের দিন।
কমলিকা কখনো তার মামাবাড়িতে যায় নি। সে শুনেছে তার দুই মাসি আর এক মামা আছে সেখানে, কিন্তু তারা কেমন তাদের অবয়ব কেমন সেবিষয়ে বিন্দুমাত্র অনুমান নেই তার। মামাবাড়ির আদর কেমন হয় সে জানে না। গরমের ছুটিতে বা ফাইনাল পরীক্ষার শেষে সব বন্ধুরা যখন মামাবাড়ি চলে যেত তখন ওর মন খুব খারাপ হতো কিন্তু ও সেটাকে প্রকাশ করতো না! কমলিকা একটু একটু করে বড়ো হতে লাগলো ও বুঝতে পারতো না ওর দোষটা কোথায়, কেন মামাবাড়ির কেউ ওকে একবারও কাছে টেনে নেয় না!
দিন বয়ে গেল তবুও মামাবাড়ির চিত্র ওর চোখের সামনে ফুটে উঠলো না! মামাবাড়ি ওর কাছে একটা ভালো স্বপ্নের মতো। গ্রীষ্মের ছুটি বা পূজোর ছুটির পর যখন ও ওর বন্ধুদের থেকে মামাবাড়ির গল্প শুনতো তখন ও নিজের মতো একটা ছবি তৈরি করে নিতো এভাবেই চলতে থাকলো।
একদিন সন্ধ্যাবেলা কমলিকা রাগে কষ্টে প্রবল অভিমান বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। সেদিন ওকে স্কুলে শুনতে হয়েছিলো ওর তো “মা ই নেই মামাবাড়ি কিভাবে থাকবে?” ও বুঝতে পারে নি কেন ওকে এই কথা শুনতে হলো, ওর মা নেই, ওর মামাবাড়ি নেই তাতে ওর দোষটা কোথায়? কেন ওকে এসব সহ্য করতে হবে?
সেদিন প্রবল অভিমানে ওর সহ্যশক্তির বাঁধটা ভেঙেই গেল। কমলিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওর বাবাকে চিৎকার করে জিঞ্জেস করেই ফেললো -” আমার মা নেই কেন? আমার মামাবাড়িতে আমি কেন যেতে পাড়ি না! আমার দোষ কী?? “
ওর বাবাও সেদিন বুঝে গেছিলো মেয়ের মনের মধ্যে এতদিন এসব প্রশ্নের বিরাট একটা পাথর ছিলো, সেই পাথর গড়াতে গড়াতে ওকে শেষ করে দিয়েছিলো ভিতর ভিতর শুধু ও প্রকাশ করতো না কখনো।
কমলিকা একরাশ আশা নিয়ে ওর বাবার মুখের দিকে করুণ ভাবে তাকিয়ে ছিলো যেন এতবছর ধরে জমে থাকা সব প্রশ্নের জবাব পাবে এখন ও। কমলিকার বাবা ওকে কাছে ডাকল ও এগিয়ে গেল একটু। ওর বাবা ভেবেছিলো এতদিনের পুরোনো সম্পর্ককে হয়ত পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে, উনি ভেবেছিলো যখন ওবাড়ির লোকজন জানবে কমলিকা এতবড়ো হয়ে গেছে এবং ও মামাবাড়ির সকলকে দেখতে চায় তখন তাঁরাও হয়ত অত্যন্ত আগ্রহের সাথে ওকে আপন করে নেবেন এসব ভাবতে ভাবতেই কমলেশবাবু ফোন করলো ওবাড়িতে কমলিকা একদম পাশেই বসা।
দীর্ঘ ১০ মিনিট কথাবার্তা হলো কমলিকা অনেক আশা নিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে মামাবাড়ি যাওয়ার মূহুর্তগুলো কল্পনা করছে। কিন্তু সেটা সাময়িকই ছিলো সবটা শোনার পরও ওবাড়ির লোকজন এমন কিছু কথা বললো যেন সমুদ্রের ধারে বালির রাজপ্রাসাদ চুরমার হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে এমন কিছু শব্দ কমলিকা শুনলো যে ওর মনে হল একটু একটু করে গড়ে তোলা কল্পনার মামাবাড়ির ওপর এক বিশালাকৃতির উল্কাপিণ্ড পড়ে গেল। ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো আকাশের দিকে, ও বারংবার আওড়াতে থাকলো মামাবাড়ি দরকার নেই ওর। ও বারবার বলতে লাগলো ফোনের ওপাশ থেকে আসা কথাটা -” যে জন্মানোর কয়েকমাস পরই আমরা আমাদের সোনার টুকরো মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম আজীবনের মতো তার সাথে আর যাই হোক কোনো সম্পর্ক আমরা রাখতে চাই নাহ্! ও আমাদের কেউ নাহ্! ওকে এবাড়িতে আনা তো দূরে থাক ওর মুখও আমরা কেউ দেখতে চাই নাহ্ “
কিছুক্ষণ আকাশের দিকেই ও তাকিয়ে থাকলো আর মনে মনে অনেক কিছু বুঝে নিলো,যেন ওই কথাগুলো ওকে অন্য মানুষে পরিনত করে দিলো। ও বুঝে গেল সবার জন্য মামাবাড়ি মজার হয় নাহ্! সবার কপালে দাদু-দিদা,মামা-মাসিদের আদর থাকে না!
কমলেশবাবুর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে কমলিকা একজন বিচক্ষণ মানুষের মতো বলে উঠলো – “তোমাকে মামাবাড়ি নিয়ে আর কোনো কথা কখনো বলবো না বাবা, মামাবাড়ির মজা সবার জন্য নয় গো! “

……………..শ্রেয়সী চ্যাটার্জী