বিকর্ণ

“ তোমার এতো বড় সাহস – আমার মেয়ের গায়ে হাত দাও? তোমাকে আমি জেলে ঢোকাব -এতো বড় আস্পর্ধা !!!!”

“ বিশ্বাস করুন ,আপনার মেয়েকে আমি মারতে চাইনি – হঠাৎ করে রাগের মাথায় এক ঘা লাগিয়ে দিয়েছি।“

“জেলের ঘানি টানলে ঐ সব রাগ টাগ উধাও হয়ে যাবে – কত আশা করে আমার আদরের বড় মেয়ের সঙ্গে তোমার আমি বিয়ে দিয়েছিলাম….”

“ বিশ্বাস করুন রাগ আমার এমনি আসেনি….. ঝগড়া হল আমার সঙ্গে, সেই রাগে মারতে লাগল আমার তিন বছরের বাচ্চা ছেলেটাকে- আপনার আদরের নাতিকে। মাথার ঠিক রাখা যায়?”

“ বাচ্চার প্রতি দরদ শুধুই তোমার একার মনে হচ্ছে? ও কি বাচ্চার মা না? খুব সাবধান! আর যদি এরকম ঘটনা আমি শুনতে পাই…তাহলে…..”

কথাগুলো বলে গট গট করে হেঁটে চলে গেল পুলিসের পোষাক পরা একটি লোক – আর তার যাওয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল সুভাষ – যাকে কথাগুলো বলা হল।

সুভাষ গ্রামের ছেলে, জলপাইগুড়ির বেরুবাড়িতে ঘর। শহরের এক সরকারি অফিসে সাইকেল, বাইক এসব দেখা শোনার কাজ করত। কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিল বারীনদা। বারীনদাও ঐ একই অফিসে কাজ করত। মাসে হাজার সাতেক টাকা দিত অফিস থেকে – এ ছাড়াও জমিজমা ছিল…চলে যেত টেনেটুনে।

সুভাষের ভাই আছে একটা আর বাবা মা। বাবা দিনমজুরের কাজ করে আর মা লোকের বাড়ি রান্নার কাজ। বাবাটার সব ভাল – শুধু রাত্রি বেলাতে চোলাই মদ খেয়ে বাড়িতে ঢোকে আর হল্লা চিল্লা করে। সুভাষরা যখন ছোটো ছিল তখন দেখত বাবা মদ খেয়ে এসে মা কে মারতে মারতে মাঝে মাঝে রক্ত বের করে দিত। বড় হওয়ার পরে সুভাষ একদিন রুখে দাঁড়িয়েছিল। তারপর থেকে বাবা মদ খেয়ে মা কে গালাগালি করে কিন্তু গায়ে আর হাত দেয় না। এই সত্তর বছর বয়সেও মদ খাওয়াটা বাবা ছাড়তে পারল না।

আর এই বাবাটার জন্যই না গতকাল ঐ রকম সুন্দর বৌটার গায়ে সুভাষকে হাত তুলতে হল! সুভাষের চোখ জলে ভরে আসে।

 

(২)

কপালটা সুভাষের বরাবরই ভাল। সাইকেল স্ট্যাণ্ডের কাজটা বছর সাতেক করার পর ঐ অফিসে একটা বিজ্ঞপ্তি আসে – যে সব চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারিবৃন্দ অস্থাযী রূপে কাজ করছে তাদের একটা লিখিত পরীক্ষায় বসতে হবে, একটা ইণ্টার্ভ্যূ হবে – তারপরে স্থায়ী করা হবে। বারীনদা ছিল ইউনিয়নের নেতা। বারীনদা স্নেহ করত সুভাষকে- এক গাঁয়ের ছেলে– সে কায়দা করে সুভাষকেও অস্থাযী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারি হিসেবে দেখিয়ে চাকরীটা এক প্রকার করিয়েই দেয়। সাইকেল দেখা শোনা করা সুভাষ স্থায়ী চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারি হয়ে যায় সরকারী অফিসে। সাত হাজার থেকে কুড়ি হাজার টাকা হয়ে যায় তার বেতন এক লাফে। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই সুভাষের বারীনদার কাছে।

“ তাহলে, এ বার দেখে শুনে একটা বিয়ে করে সংসার শুরু কর। বয়স তো ত্রিশ হয়ে গেল। এরপর ভালো পাত্রী পাবি না। এখন সরকারী চাকুরী করিস – বিয়ের বাজারে খুব দাম তোর। যদি বলিস তো আমিই তোর জন্য মেয়ে দেখি – কি বলিস?”

লজ্জা পেয়েছিল সুভাষ – কিন্ত ঘাড় নেড়ে সম্মতিও দিয়েছিল -একটা সুন্দর স্বপ্নে বিভোর হয়ে গিয়েছিল মন প্রান। ঢিব করে পায়ে হাত দিয়ে একটা প্রনাম করে ফেলেছিল বারীনদাকে সেদিন।

“ আরে দেখো দেখো কি করে ছেলেটা – বিয়ের কথা বলতেই একেবারে ধান ভরা গাছের মত নুয়ে পড়েছে দেখো। “ মুচকি হেসে বারীনদা বলেছিল।

বারীনদা যে মেয়েটির সম্বন্ধ এনেছিল সে যে সুভাষের বৌ হতে পারে সেটা সুভাষের পরিবার কোনদিন ভাবতেও পারেনি। মেয়েটি BA পাস, দেখতে সুন্দরী, ভালো পরিবার, বাবা পুলিশে চাকুরী করে – আর আমাদের সুভাষ ক্লাস এইট পাস। তবুও মেয়ের বাবা এগিয়েছিল ছেলে সরকারী চাকুরী করে এই ভেবে। আর তার আরো দুটি মেয়ে আছে, সুতরাং বড় মেয়ের বিয়ে দিতে দেরী হলে তাদের বিয়ে দিতে দেরী হবে এই চিন্তা করে।

মেয়ে দেখার দিন বারীনদাও গিয়েছিল সঙ্গে। পাশেই কাদোবারি গ্রামের মেয়ে। মেয়ে দেখার পর্ব মিটে যাবার পর বাসে করে বাড়ি ফেরার সময় বারীন দা জিজ্ঞেস করেছিল – “ কি রে? মেয়ে পছন্দ হল?” এক গাল লাজুক হাসি হেসে সুভাষ ঘাড় কাত করেছিল।

বিয়েটা ধুমধাম করে হয়েছিল। বিয়ের রাতে বাসর ঘরে সুভাষ সদ্য বিয়ে হওয়া নতুন বউকে জিজ্ঞেস করেছিল –“ কি গো, আমাকে ভালোবাসতে পারবে ? “ বৌ অবাক চোখে সুভাষের দিকে তাকিয়েছিল – তারপরে আস্তে আস্তে ঘাড় নেড়েছিল । এরপর সুভাষ আর কথা বাড়ায়নি। একটা উপোসী জন্তুর মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বউয়ের ওপর। বৌ সব সহ্য করেছিল।

সুভাষ বৌ কে ভালবাসত – কিন্তু সেটা ছিল একটা গ্রাম্য রক্ষণশীল ভালবাসা।

“ সবাই বাইরে কাজ করে, আমার বন্ধুরাও করে…আমিও চাকরী করব বাইরে…এতে সংসারের সাশ্রয় ও হবে “ সুভাষের বৌ প্রায়ই বলত সুভাষকে।

“ না, আমাদের এখানে ঘরের বৌ বাইরে কাজ করে না- সংসার কে দেখবে? বাচ্চাকে কে দেখবে? আমার বাবা মা কে কে দেখবে?” সুভাষ উত্তর দিত।

“ যারা চাকরী করে তাদের বাড়িতে কে দেখে?”

“ দেখ, আমি অতশত বুঝি না – মোদ্দা কথা তুমি চাকরী করবে না।“

সুভাষ গজগজ করে অফিসে বেড়িয়ে গেল – বৌ উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকল। কলেজের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে – কত স্বপ্ন দেখত চাকরী করবে, সংসার করবে, বাচ্চা মানুষ করবে, একজন আদর্শ যুগোপযোগী বৌ হবে – আজ বিয়ের চার বছর পর প্রথম স্বপ্ন পূরণের কোনো আশাই দেখতে পেল না শীলা – মানে সুভাষের বৌ। তিন বছরের ছেলে এসে শাড়ি ধরে টানতে লাগল “ মা, খেতে দাও…খিদে পাচ্ছে “…কিন্তু শীলা নিরুত্তর রয়ে গেল – দু চোখে জলের ধারা। গোয়ালে গোরু গুলো ডাকছে খাবার দেওয়ার সময় হয়েছে – শীলা অবিচল – বাবার ওপর রাগ হচ্ছে – বাবা বলেছিল-“ বিয়ের পর চাকরী করবি “- কিন্তু এখন তো সব বিশ বাঁও জলে।

“ আরে বৌ, ছেলেটা কাঁদছে…গোরুগুলো ডাকছে – কোনো হুঁশ নাই? ও, সুভাষের বাবা, এ কেমনতর বৌ তুমি ঘরে আনলে গো? ‘

“ আমি কি করব…আমি কি জানতাম বৌ মা আমার পাটরানী হবে? তক্ষুনি বলেছিলাম যে অত শিক্ষিত বৌ আমাদের ঘরে চলবে না – তা.. তুমি তো শুনলে না।“

“ তখন কি আর জানতাম গো…এরকম হবে…পোড়া কপাল আমার!”

চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল শীলা – এসব কথা শুনতে শুনতে এই চার বছরে তাঁর গা সহা হয়ে গিয়েছে।

(৩)

আজ সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি হচ্ছে…যদিও ডিসেম্বরের শেষ দিক, তবুও হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছে। শীলা আনমনে ছাতা মাথায় দিয়ে সামনের কলটা থেকে জল আনতে যাচ্ছিল। সুভাষ কালকে রাত্রে আরেকটা বাচ্চার জন্য জোরাজুরি করছিল – কোনোমতে ওকে আটকানো গেছে। এই অসময়েও দু একটা ব্যাঙ ডাকছে – সাথী খুঁজছে বোধ হয়।

“বৌদি কোথায় যাচ্ছ? জল আনতে? “

শীলা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল মনোজ। এ পাড়ারই ছেলে। শিক্ষিত। বাঙলায় এম এ। শিক্ষকতা করে পাশের গ্রামের স্কুলে। লেখালেখিও করে। একটা পত্রিকা বের করে তিন মাস অন্তর অন্তর – নাম “ মানসী “। শীলা ও বেশ কয়েকবার লেখা দিয়েছে পত্রিকাতে। শীলা কবিতাটা ভালোই লেখে। স্কুল কলেজে যখন পড়ত অনেক গুণী জনের প্রশংসা সে পেয়েছিল। ওসব ভাবলে এখন চোখে জল আসে।

“ হ্যাঁ, মনোজ জল আনতে যাচ্ছি…তুমি কি স্কুলে?”

“ হ্যাঁ বৌদি। আজকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি – বিকেলে স্কুলে একটা সাহিত্য সভা হবে। বিখ্যাত লেখক প্রমোদ সরকার আসবে। তুমিও আসতে পারো বৌদি।“

আর যাওয়া! মনে মনে ভাবল শীলা। বাড়ীর থেকে কোথাও বের হতে গেলে চোদ্দ গণ্ডা ফিরিস্তি দিতে হয়। এই যে মনোজের সঙ্গে কথা বলছে এটা নিয়েও হয়ত জবাব দিহি করতে হবে, যদি কেউ দেখে ফেলে, বিশেষ করে পাশের বাড়ির পরানের মা…এরকম জটিল কুটিল মহিলা সে কোনদিন দেখেনি। এর খবর তাকে আর তার খবর একে না লাগান পর্যন্ত পেটের ভাত হজম হয় না যেন। এই যে মনোজ তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলে, লেখা নেয়, এটা নিয়েও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হহয়েছি শীলাকে ।মনোজকে সে ভাইযের মত দেখে, পাঁচ বছরের ছোটো শীলার থেকে, খুব ভালো মনের ছেলে, পরোপকারী। কিন্তু সেদিন রাত্রে শ্বশুর মদ খেয়ে এসে যা আকথা কুকথা বলল, সুভাষ তার কোনো প্রতিবাদ করল না। অবাক হয়েছিল শীলা। সুভাষ এমনিতে কোনো নেশা ভাঙ করে না, কিন্তু বাবা প্রতি রাতে মদ খেয়ে হল্লা চিল্লা করলে তারও কোনো প্রতিবাদ করে না। কিন্তু সেই রাতে মনোজকে নিয়ে সুভাষের বাবা যে নোংরা কথাগুলো বলেছিল, সুভাষ অন্তত তাঁর প্রতিবাদ করবে শীলা ভেবেছিল , কিন্তু শীলাকে অবাক করে দিয়ে সুভাষ চুপ ছিল। তাহলে কি সুভাষ ও তাকে !!!!???? আর ভাবতে পারে না শীলা…একটা ঘেন্নায়

গা গুলিয়ে ওঠে তার।

“ না ভাই- আমার যাওয়া হবে না আজকে। অন্য কোনদিন যাবো “ না করে দিল শীলা মনোজকে।

“ কিন্তু অন্য দিন প্রমোদ সরকারকে হাতের সামনে পাবে না বৌদি।“ মনোজ মুচকি হাসে। শীলাও হাসে, কিন্ত একটা যন্ত্রনার প্রকাশ যেন চোখে মুখে ফুটে ওঠে শীলার। মনোজের নজর সেটা এড়াল না।

দুপুরের দিকে মনোজের ফোন আসল শীলার কাছে। সারা দুপুর গুম হয়ে থাকল শীলা। জানালার বাইরে তাদের জমিতে ধান গাছ গুলোর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকল। দুটো গোরু চড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে মেঠো পথ দিয়ে নোসু কাকা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে বাড়ীর দিকে মুদি খানার দোকানটা বন্ধ করে – বোধ হয় দুপুরে খেতে। শীলা আনমনে সব দেখে যাচ্ছিল। ছেলেটা খেলছিল মেঝেতে। শীলা জোর করে উঠে তাকে ঘুম পাড়াতে গেল। ছেলে কান্না জুড়ল। পাশের ঘর থেকে শ্বাশুড়ি মুখ ঝামটা দিল। শীলা তোয়াক্কা না করে অনেক কষ্টে ছেলেকে ঘুম পাড়াল।

“ এখন কবিতা পাঠ করতে আহ্বান করছি শ্রীমতি শীলা রায়কে।“ মঞ্চে ঘোষনা হতেই শীলা উঠে দাঁড়াল। শাড়ীর আঁচলটা ঠিকঠাক জড়িয়ে নিয়ে মঞ্চে উঠে প্রনাম করল শ্রী প্রমোদ সরকারকে, তারপর ধীরে ধীরে আবৃত্তি করল তার সদ্য লেখা পাঁচটি কবিতা। প্রমোদ সরকার নিজে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন। আবেগ তাড়িত গলায় বলে উঠলেন –“ অনেকে দিন পরে এতো সুন্দর কবিতা শুনলাম। কোথায় থাকো তুমি?”

“ পাশের গ্রামেই “

“ তোমার লেখা আমাকে পাঠিয়ে দিও…আমি বড় পত্রিকায় পাঠিয়ে দেব।“

কৃতজ্ঞ চোখে মাথা নাড়ল শীলা। দূরে দাঁড়িয়ে মনোজ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল মনোজের দিকে – তার চোখের আনন্দাশ্রু নজর এড়াল না শীলার।

(৪)

“ শালা মাগী বৌ…দুপুর বেলা পরপুরুষের সঙ্গে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যাস, মেরে তোকে আজকে লাশ বানাব শালী…” সেই রাতে মদ খেয়ে এসে তুমুল হই চৈ শুরু করল সুভাষের বাবা। আশেপাশের লোক জড় হয়ে গেল।পরানের মা এক নাগাড়ে ছি: ছি: করে যেতে লাগল…..

সুভাষ বাবাকে সামলাতে পারছিলে না। মাথা ঠিক রাখতে না পেরে সুভাষ এবার নিজেই একটা লাঠি নিয়ে শীলাকে পিটাতে শুরু করল। ছেলেটা চীৎকার করে উঠল। বারীনদা ছুটে এসে সুভাষকে ধমকে থামাল। এবার শীলা এক অদ্ভুত কাণ্ড করল – “ এ বাড়িতে থাকলে আমার ছেলে অমানুষ তৈরী হবে – ওকে আমি এখনি মেরে ফেলব “- বলে ছুটে গিয়ে তার তিন বছরের ছেলের গলা টিপে ধরল। এ দিকে সুভাষ ছেলে অন্ত প্রাণ ছিল। সে মাথা ঠিক রাখতে পারল না। সজোরে গিয়ে লাথি মারল শীলার তলপেটে। “ মা গো – মরে গেলাম” বলে শীলা জ্ঞান হারাল।

এরপরের ঘটনার কিছুটা পাঠক হয়ত জানেন, কারন, গল্পের শুরুতে যে কথোপকথন ছিল সেটি এই ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো এক হিতাকাঙ্ক্ষী শীলার বাবাকে ঘটনাগুলি জানিয়ে পরদিন সকালে ফোন করে। শীলার মা তড়িঘড়ি তার ছেলেকে নিয়ে শীলার শ্বশুর বাড়ি ছুটে গেল। আর শীলার পুলিশ বাবা সটান গিয়ে হাজির হল জামাইযের অফিসে। জামাইকে একপ্রস্থ ধমকানো এবং ৪৯৮ ধারার ভয় দেখানোর পর শীলার বাবা থামল। ইতিমধ্যে অফিসের লোক জড় হয়ে গেল – সবাই ছি:! ছি:! করতে লাগল।

আরো একপ্রস্থ জামাইকে ধমকানোর পর গট গট করে চলে গেল শীলার বাবা। সুভাষ চুপ হয়ে গেল। অফিসে তার যথেষ্টই বদনাম হয়ে গেল। সবাই এসে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে…এটা আরো খারাপ লাগছে সুভাষের। বাবাটা যদি ঐ ভাবে চিল্লামিল্লি না করত, আর বৌটা যদি ছেলের গলা টিপে না ধরত, তবে কি আর তার মাথা গরম হোত? মাথা গরম না হলে বৌটার গায়ে হাতও তুলত না… বৌটা খারাপ না…যত্ন আত্তি করে সুভাষের, সংসারের কাজও করে, কিন্ত বাইরে কাজ করার কথা বললেই খুন চেপে যায় সুভাষের মাথায়। কেন জানিনা মনে হয় তার বৌটাকে কেউ ভাগিয়ে নিয়ে যাবে। এত গুণ তার বউয়ের…পড়াশুনোয় ভালো, দেখতে ভালো, লেখালেখি করে। অনেক ভাগ্য করে বৌ পাওয়া গেছে…ভাবে সুভাষ। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে রওনা দিল সুভাষ সাইকেল চেপে।

বাড়িতে একটা গুমোট আবহাওয়া। শীলার মা সকালবেলা শীলাকে এ বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়েছে । এ খবর সুভাষ জানত না। কাল অনেক রাত পর্যন্ত গণ্ডগোল হওয়ার পরে ডাক্তার ডেকে আনে পাড়ার লোক – দেখান হয় শীলাকে- জ্ঞান ফেরে শীলার – কিন্তু পেটের তলায় ব্যথা ছিল – আলট্রা সোনোগ্রাফি করতে বলে গিয়েছে ডাক্তারবাবু – ফিমেল ওর্গানে কোনো ক্ষতি হতে পারে – সন্দেহ করেছে। ভোরের দিকে চোখ বুঁজে ছিল সুভাষ। অফিস যেত না – কিন্তু ছুটি গুলো সব শেষ – মায়না কাটা যেত – সেই ভয়ে গিয়েছিল।

মা বিছানায় শুয়ে আছে । বাবা দাওয়াতে বসে আছে। আজকে কাজে যায়নি – মদও খায়নি। সুভাষ বাড়িতে ঢুকতে একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে আবার মাথা নীচু করল। একটা অপরাধবোধ যেন চোখেমুখে। সুভাষ নিজের ঘরে গিয়ে বসল ধীরে ধীরে। অফিসের জামা কাপড় ছাড়তে ইচ্ছে করল না – গোটা বাড়িটা যেন গিলতে আসছে। অন্যদিন হলে ছেলেটা এসে নানা রকম বায়না করে, পাগল করে দেয় সুভাষকে- আজ শুধুই শূন্যতা। শীলা অন্যদিন সাজিয়ে গুছিয়ে টিফিন নিয়ে আসে এই সময়। তৃপ্তি করে খায় সুভাষ – আজকে কেউ নেই কিছু নেই যেন। দূরের কোনো ঘর থেকে শাঁকের আওয়াজ বেজে উঠল – চমকে উঠল সুভাষ – শীলাও তো এই সময় বাজাত।

সারা রাত ছটফট করল সুভাষ – ঘুমাতে পারলো না – শুধুই ছেলেটার কথা মনে পড়ছে – বৌটার কথা মনে পড়ছে – কাল কি জোরে মেরেছে তলপেটে – খুব জোর লেগেছে বৌটার। বৌ বিয়ের পর প্রথম প্রথম হাত বুলিয়ে দিত মাথায় – কি যে সুখ লাগত! চোখে জল চলে এল সুভাষের –

সকাল হতেই সুভাষ ছুটল শ্বশুর বাড়ি বউকে আনতে। কিন্ত সুভাষকে দেখেই তেড়ে এল সুভাষের বাবা আর ভাই। চীৎকার করে উঠল সুভাষের শালা – “ দিদির মাথায় যদি তোর নামের সিঁদুর না থাকত, তাহলে জ্যান্ত কবর দিতাম তোকে আজকে – শালা হারামি…” রাগের চোটে বড় ছোট জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে শীলার ভাই।

শীলার বাবাও তেড়ে এল, “ দ্যাখ, আমার মেয়েটার কি দশা তোরা করেছিস…ও ঠিকমত হাঁটতে পর্যন্ত পারছে না। আল্ট্রা সোনোগ্রাফির রিপোর্ট কি জানিস? ওর uterus এ এমন ক্ষতি হয়েছে…ওটা কেটে বাদ দিতে হবে। শালা জানোয়ার পরিবারে বিয়ে দিয়েছিলাম আমার মেয়ের।“

সুভাষ লক্ষ্য করল তার ছেলেও বাইরে এসে দূর থেকে তাকে ভয়ে ভয়ে দেখছে। একটা বিষাক্ত পরিবেশ চারিদিকে।

“ আমি ওকে নিয়ে যেতে এসেছি…এরকম আর কোনদিন হবে না…বড় ভুল হয়ে গিয়েছে রাগের মাথায়…আমি অনুতপ্ত…” কাতর আবেদন করল সুভাষ।

“ বাবা, ওকে বলে দাও…ঐ বাড়িতে আমি আর কোনদিনই যাবো না… মরে গেলেও না…” ঘরের ভেতর থেকে চীৎকার শোনা গেল শীলার। সুভাষ ঘরের ভেতর যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু শালা আর শ্বশুর পথ আটকালো। এমনকি তার ছোটো ছেলের দিকে হাত বাড়াতেও সে ছুটে ঘরের ভেতর চলে গেল।

সুভাষ বিফল মনোরথে ফিরে আসল। একটা প্রচন্ড ঘৃণার চোখে শীলা তাকে দেখেছিল আজকে – এটা সুভাষকে খুব পীড়া দিল। আজকে অফিস যেতেও মন করছে না। বারো বিঘা জমি আছে তাদের। এই শীতকালে আলুর চাষ করেছে। গতকাল বৃষ্টি হয়েছিল…. শীতকালের এই অকাল বর্ষণ আলু চাষের পক্ষে খুব ভালো.. প্রচুর আয় হবে মনে হচ্ছে এবার আলু চাষ থেকে…আলু ক্ষেতের সামনে গিয়ে বসল সুভাষ…কিন্তু কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না আর…গোটা পৃথিবীটাই পানসে মনে হচ্ছে যেন। মনোজ এসেছিল শীলার খোঁজ করতে…অন্যদিন মনোজকে দেখে রাগ হত সুভাষের, কিন্তু আজকে আর রাগ হোলো না, কেন জানিনা সুভাষের মনে হল ছেলেটি বড় ভাল।

বেশ কয়েকমাস কেটে গেল…শীলা এল না…অনেক চেষ্টা করেছিল সুভাষ, এমনকি শীলার বাবা মা ও তাকে শেষ বারের জন্য শ্বশুর বাড়ি যেতে বলেছিল, কিন্তু শীলা কিছুতেই রাজী হয়নি। অনেকে সুভাষকে আবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু সুভাষ রাজী হয়নি। আরো কিছু মাস কেটে গেল। সুভাষ ধীরে ধীরে স্থির করে ফেলল, এই জায়গাতেই সে আর থাকবে না, কারন, বৌ আর ছেলের স্মৃতি তাকে প্রতি মুহূর্তে পীড়া দেয়। সব জায়গাতেই সে তাদের ছায়া দেখে। অনেকে তাকে উপদেশ দিয়েছিল – বৌ আর শ্বশুরবাড়ির বিরূদ্ধে কেস করতে, বউকে ডিভোর্স করতে ইত্যাদি- কিন্তু পারেনি সুভাষ – ভেতর থেকে কে যেন আটকে দিয়েছিল। সুভাষের ভাই কোলকাতায় একটা প্রাইভেট company তে ওয়াচ ম্যানের কাজ করে। সুভাষ মনে মনে স্থির করে ফেলল সে কোলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে ভাইযের কাছেই থাকবে। এখানে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। ট্রান্সফারের জন্য সুভাষ অফিসে ধরাধরি শুরু করল। বারীনদা ইউনিয়নের নেতা – তাই তাকেও বলল – কারন, এইসব ট্রান্সফারে ইউনিয়নেরও একটা ভূমিকা থাকে।

 

(৫)

এরপর প্রায় দশ বছর কেটে গিয়েছে। আজকে বাঙ্গলার সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে শীলা রায় এক অতি পরিচিত নাম। তাঁর লেখা বাঙ্গলার বড় বড় পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়। বিভিন্ন সাহিত্যিক ও উচ্চ মানের সাহিত্য সমালোচকেরা তাঁর লেখার ভূয়সী প্রশংসা করে থাকেন। বিভিন্ন রকম পুরষ্কার তিনি ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। তাঁর দুটো গল্প নিয়ে সিনেমাও হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই । শ্রীমতি শীলা রায় আজকে বাঙলা দেশ যাচ্ছেন ওখানে ভাষা দিবসে বিশেষ অতিথির নিমন্ত্রণ পেয়ে। বিমান ছাড়তে এখনো বেশ কিছুক্ষণ দেরী আছে। শীলা বসে বসে ভাবছিল – মানুষের জীবনে ইশ্বর যা কিছু করেন ভালোর জন্যই করেন। আজকে বাবা মার মুখের দিকে তাকিয়ে সে দশ বছর আগে যে বিযেতে রাজী হয়েছিল সেটা ভেঙ্গে দিয়ে ইশ্বর ভালোই করেছেন।না হলে সে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হত – আজকে আমাদের দেশের মেয়েদের বিশেষ করে গ্রামের মেয়েদের বা গৃহবধূদের কি নিদারুণ অবস্থা সেটা সে নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে। আজকে তার সাহস ও জেদ ছিল বলে সে ফিরে যায়নি শ্বশুরবাড়ি। সে বদলে দিয়েছে নিজের জীবনের ভাগ্যরেখা- যদিও সে ভাগ্যে বিশ্বাস করে না -কর্মই তার জীবনের মূলমন্ত্র, কিন্ত শীলা নিশ্চিত যে তার জায়গাতে অন্য কোনো মেয়ে থাকলে ফিরে যেত আবার সেই অশিক্ষিত শ্বশুরবাড়িতে, তারপরে কাটাত এক নরকের জীবন, যাকে হয়ত সমর্থন করত কিছু অন্ধ ধর্মবিশ্বাসী । দেশের মেয়েদের একবিংশ শতাব্দীতেও এই দুর্দশার কথা ভেবে চোখ ফেটে জল আসে শীলার – কি যেন একটা যন্ত্রনা দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয় তাকে। আর তাই তো তার কাব্যে উপন্যাসে এই নারী যন্ত্রনার কথা ফুটে ওঠে বারবার। ফ্লাইটে ওঠার ঘোষনা হয়ে গেল- ধীরে আত্মবিশ্বাসী পায়ে উঠে দাঁড়াল শীলা- বোর্ডিং পাস হাতে এগিয়ে গেল নির্দিষ্ট লাইনের দিকে। ঠিক সেই মুহুর্তে তার মোবাইলে ঢুকল একটি মেসেজ – “ হ্যাপী জার্নি মামনি”- নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে পাঠিয়েছে তার ছেলে নির্ঝর- সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে সেখানে – মেধাবী ছাত্র এবং শীলার জীবনের একমাত্র নিস্বার্থ আনন্দ, আশা, ভরসা।

আজকে খুব ভালো লাগছে শীলার সকাল থেকেই – কারন, ভাষা আন্দোলোনের একটা বিশেষ অনুষ্ঠানে সে আমন্ত্রিত – আর তার গোটা জীবনটাই তো একটা আন্দোলন, একটা প্রতিবাদ, মেয়েদের প্রতি এই সমাজের অসম দৃষ্টিভঙ্গির বিরূদ্ধে। সকালে উঠেই সে স্নান করে নিয়েছে, ঠিক দশটায় গাড়ী নিতে আসবে হোটেল থেকে । মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল এগারোটায় ঢাকার শহীদ মিনারের সামনে। ভারত থেকে ওনারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আরেকজন লেখককে, যিনি ইদানীং খুব নাম করেছেন এবং উদীয়মান লেখকদের যে সর্বোচ্চ সম্মান পশ্চিমবাঙলার বাংলা আকাদেমি থেকে দেওয়া হয়, সেই কৃত্তিবাস সম্মান প্রাপক। উনি সবসময় “বিকর্ন” ছদ্মনাম নিয়ে লেখেন এবং নিজের আসল নাম কাউকেই জানান না, এমনকি নিজের আসল নাম উনি “ কৃত্তিবাস” পুরষ্কারটি নেবার সময়ও ঘোষনা করতে দেননি। এমনকি ওনার পুরো মুখ কেউ কখনও দেখতে পান না, কারন মিডিয়ার সামনে ছবি তোলার প্রয়োজন হলে উনি একটা বড় কালো সান গ্লাস ব্যবহার করেন যেটা দিয়ে ওনার মুখের বেশীরভাগই ঢাকা পড়ে যায়, সঙ্গে একটা টুপি ও উনি ব্যবহার করেন ফোটো তোলার সময় -বোধ হয় নিজেকে আরো বেশী আড়াল করার জন্য লোকের সামনে। কিন্তু কেন এই আড়াল অনেক ভেবেও শীলা বের করতে পারেনি। উনি যে লেখাগুলো লেখেন সেগুলো সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিশেষতঃ সমাজের নারীদের বিভিন্ন পীড়ন মূলক ঘটনা তার লেখায় বারেবারে ফুটে ওঠে যেটা শীলার খুব ভালো লাগে, কারন শীলা নিজেও ঐ ধরণের লেখা লেখে। কিম্বদন্তী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কেও খুব ভালো লাগে শীলার তাঁর নারীদরদী লেখার কারণে। শীলা শুধু ভাবে যে এনারাও পুরুষ, আবার তাঁর শ্বশুরমশাইও পুরুষ, তার প্রাক্তন বর সুভাষও পুরুষ – পুরুষ না বলে এদের কুপুরুষ বলা ভাল, আজকে সমাজের বেশীরভাগ পুরুষই এই কুপুরুষ গোত্রের কাপুরুষ – ভাবতে ভাবতে ঘৃণার স্পষ্ট অভিব্যক্তি ফুটে উঠল প্রবল নারীবাদী শীলার মুখে চোখে।

 

 

(৬)

ঠিক দশটায় গাড়ী হর্ন দিল হোটেলের সামনে। শীলা তৈরী ছিল, নেমে এল নীচে। গাড়ীতে উঠতে গিয়ে চমকে উঠল শীলা – গাড়ীতে আরেকজন বসে আছেন এবং তিনি আর কেউ নন, সেই কালো সান গ্লাস চোখে, মাথায় টুপি – পরিচিত মুখ – লেখক বিকর্ণ। শীলাকে দেখে নমস্কার করলেন বিকর্ণ। প্রত্যুত্তরে শীলাও স্মিত হেসে নমস্কার করল। গাড়ী ছুটে চলল ঢাকার শহীদ মিনারের দিকে।

সারা রাস্তায় আর একটিও কথা হয়নি বিকর্নের সঙ্গে শীলার। বিকর্ণ সারাক্ষণ গাড়ীর কালো কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। শীলাও আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলেনি।

গাড়ী পোঁছে গেল শহীদ মিনারের সামনে। বাঙলাদেশের সমস্ত বিশিষ্ট জনেরা এসেছেন –রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী সভার অন্যান্য মন্ত্রীরা, সাংসদেরা এবং বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি, লেখক, শিল্পী ইত্যাদি। শহীদ মিনারের পাদদেশে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের পর সবাই এগিয়ে গেলেন পাশেই ব্যবস্থা করা মূল অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে। বিকর্ণ এবং শীলাকে পাশাপাশি বসতে দেওয়া হয়েছিল। বাঙলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “ আমার সোনার বাঙ্গলা “ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। বিভিন্ন গীতি আলেখ্য, নাচ গান ইত্যাদি হতে লাগল। শীলার নারী স্বত্বা বারবার বলতে লাগল বিকর্ণ তাকে আড় চোখে ক্রমাগত দেখে যাচ্ছে।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পর সাহিত্য অনুষ্ঠান শুরু হল – বাংলাদেশের প্রথিতযশা লেখক, শিল্পীদের কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি পাঠের পর ঘোষক ঘোষনা করলেন : এবারে মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতবর্ষ থেকে আগত অত্যন্ত আদরণীয় অতিথি সাহিত্যিক শ্রীমতি শীলা রায় এবং শ্রী বিকর্ণকে।“ তুমুল হাততালির মধ্য দিয়ে শীলা আর বিকর্ণ মঞ্চে গিয়ে বসলেন।

বিকর্ণকেই বলা হয়েছিল প্রথমে কিছু বলার জন্য, কিন্তু বিকর্ণ শীলাকে আগে বলার জন্য অনুরোধ করলেন। শীলা খুব সুন্দর করে ভাষা দিবসের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে নিজের কিছু কবিতা পাঠ করল। বিপুল করতালির মধ্যে শীলা নিজের আসন গ্রহন করল। এবার আহ্বান করা হল বিকর্ণকে কিছু বলার জন্য। বিকর্ণ ধীর পায়ে উঠে মাইকের দিকে এগিয়ে গেলেন। চারিদিকে পিন ড্রপ সাইলেন্স।

বিকর্ণ তাঁর ভাষণ শুরু করলেন ভাষা দিবসের শহীদদের প্রতি তাঁর আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ভাষা দিবসের মাহাত্ম্য তিনি বর্ণনা করলেন। ভাষা দিবসের উপর তাঁর লেখা কিছু প্রবন্ধ ও কবিতা পাঠ করলেন। তারপরে সবাইকে চমকে দিয়ে শুরু করলেন,” আজকে এই ভাষা দিবসের পুণ্য দিনে আমি আমার আসল নাম আর পরিচয় সারা পৃথিবীর বঙ্গ সমাজের সামনে রাখব – আজ সেই পুণ্য ক্ষণ যার জন্য আমি অনেকদিন অপেক্ষা করেছি…অনেকে অনেক দিন… “

বলতে বলতে চোখের অতিকায় সানগ্লাসটা খুলে ফেললেন বিকর্ণ- আবেগে চোখ মুছলেন যেন। নড়েচড়ে বসল শীলা – যে ছেলেটি টিভি তে লাইভ কাভারেজ দিচ্ছিল সে ক্যামেরাটা নিয়ে বিকর্ণের একদম মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ল। বিকর্ণ এবার ধীরে ধীরে নিজের মাথার থেকে টুপিটা খুললেন। শীলা চমকে উঠে মেরুদণ্ড সোজা করে বসল চেয়ারে। মুখটা খুব চেনা চেনা ঠেকছে যেন.. খুব চেনা। শীলার ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে…নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। বিকর্ণ তখন বলে চলেছেন…

“ আমি জানি বাঙ্গলার সাহিত্য মহলে আমার আসল নাম জানা নিয়ে আগ্রহ সবার…আজকে ভাষা দিবসের পুণ্য ক্ষণে আমার আসল নাম আমি জানাব সবাইকে…জানাব এই বাঙলার আপামর সাহিত্যপ্রেমীদের, কিন্তু তার আগে আমি জানাব যে আমি বিকর্ণ ছদ্মনাম কেন নিলাম সেই কথা। সুধী মহোদয় / মহোদয়াগন আপনারা সবাই জানেন যে বিকর্ণ মহাভারতের এক চরিত্র – যে দুর্যোধনের একশ ভাইযের মধ্যে এক ভাই। বিকর্ণ কিন্ত দুর্যোধনের ভাই হলেও দুর্যোধন দু:শাসনের মত অধার্মিক ছিলেন না। যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় হেরে গিয়ে দ্রৌপদীকে কৌরব সভায় সবার সামনে পণ্য করে তুললেন.. তখন দুর্যোধনের নির্দেশে দু :শাসন গিয়েছিল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে। অনেক জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি সেই সময় সভায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদ করেননি – একমাত্র বিকর্ণ ছাড়া। বিকর্ণ তীব্র প্রতিবাদ করেন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের এবং সেই সভা ত্যাগ করেন। আমারও ব্যক্তিগত জীবনে আমার প্রিয় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের চক্রান্তে আমার অতি আপনজনেরা আমাকে সামিল করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি সব তছনছ করে বিকর্ণের মতই সেই আপনজনদের সভা থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাই আমার ছদ্মনাম বিকর্ণ। তারপর তিলে তিলে নিজেকে তৈরী করেছি আমার দ্রৌপদীর যোগ্য হবার জন্য। আমি মূর্খ কালিদাস ছিলাম, কিন্তু আমি দস্যু রত্নাকরের মতই নিজেকে বাল্মিকীতে রূপান্তর করেছি…মুর্খ কালিদাস থেকে পন্ডিত কালিদাস হয়েছি…আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি আত্ম প্রচার করছি.. অহংকার প্রকাশ করছি…কিন্তু বিশ্বাস করুন…আমি মিথ্যে বলছি না.. আমি যখন আমার দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার দু:খে ঘর ছেড়েছিলাম, তখন আমি ক্লাস এইট পাস ছিলাম আর আজকে আমি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পি এইচ ডি করেছি বাঙলা সাহিত্যে। আর আমার দ্রৌপদী আজকে খুব কাছেই আছে আমার…খুব কাছে…তাই তার সামনেই আজকে আমি আমার আসল নাম বলব। আমার আসল নাম হল…..”

“ আপনার আসল নাম হল সুভাষ রায়, বিকর্ণ বাবু…আর আপনার দ্রৌপদীর নাম হল শ্রীমতি শীলা রায়…কি আমি ঠিক বললাম তো?” সবাইকে চমকে দিয়ে বিকর্ণ ওরফে লেখক সুভাষ রায়ের হাত থেকে মাইকটা নিয়ে ঘোষনা করল শীলা। সবাই হতবাক – কিছুক্ষণ সবাই চুপ – তারপর শীলার হাত থেকে মাইকটা ধীরে ধীরে নিয়ে সবাইকে শোনানোর জন্যই যেন সুভাষ দৃঢ় অথচ শান্ত ধীর গলায় বলে উঠল _” হ্যাঁ “।

তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল শহীদ মিনারের ময়দান।

 

(৭)

অনুষ্ঠান শেষে একই গাড়ীতে ফিরছিল শীলা ও সুভাষ। শীলা অনেক প্রশ্ন করে এটুকু জানতে পারল যে সুভাষ কলকাতা ট্রান্সফার নিয়ে ভাইয়ের কাছে থেকে অফিসের পাশাপাশি পড়াশুনোও চালিয়ে যায় মনপ্রাণ দিয়ে। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার ডিগ্রী করে এবং ওখান থেকেই পি এইচ ডি।

“ কিন্তু কি দরকার ছিল তোমার এত পরিশ্রম করার?” আগ্রহী শীলা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন আমাদের বিকর্ণ, তারপর আস্তে আস্তে বলা শুরু করলেন, “ তুমি আমাকে বুঝতে পারোনি শীলা কোনদিনই। আমি তোমাকে খুব খুব নিজের ভাবতাম – তাই চাইতাম না তুমি বাইরে যাও,কাজ করো – কারন আমি চাকরী করতে গিয়ে দেখেছি পৃথিবী আগের মত বোধ হয় পরিষ্কার নেই, মেয়েদের দিকে ছেলেরা অন্য নজরে দেখে এখন, কোনো কিছুর তোয়াক্কা করে না। শুধু ভোগ চারিদিকে…আমার শীলাকে কেউ অন্য নজরে দেখুক আমি চাইতাম না। আমি শুধু তোমাকে একান্ত আমার করে চাইতাম। বাবার কথায়, মায়ের কথায় সেদিন আমি দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমি মনোজকে ঘৃণা করতাম কারন তুমি ওর সঙ্গে বেশী মিশতে – তাই বাবার কথায় সেদিন আমি তোমার গায়ে হাত তুলে বসি। কিন্তু আমি যে কত বড় ভুল করে ফেলেছি সেটা বুঝতে পারি তোমাকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে বিফল হয়ে এবং তোমার চোখেমুখে আমার প্রতি ঘৃণা দেখে। সেদিন আমি বুঝেছি আমার কিছু ভুল হচ্ছে…আমি বুঝেছি যে তোমাকে বুঝতে গেলে আমাকে লেখা পড়ায় তোমার সমকক্ষ হতে হবে তাহলে হয়ত আমি তোমার মানসিকতা বুঝতে পারব। কিন্তু ওখানে থেকে আমার পড়াশুনো হোত না, কারন, তুমি বিহীন বাড়ি ঘর গুলো আমাকে গিলতে আসত – তাই কলকাতায় এসে মনপ্রাণ দিয়ে পড়াশুনো শুরু করা। তুমি ভালো বাংলা লিখতে তাই আমিও বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে ফেলি এবং বাঙ্গলা ভাষায় অনার্স নিয়ে অবশেষে এম.এ ও পী এইচ ডি। কিন্তু বাংলা পড়তে গিয়ে ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তোমার লেখা পড়তে গিয়ে আমি বাংলা ভাষাকে অন্তর থেকে ভালোবেসে ফেলি… বুঝি যে এত মিষ্টি ভাষা সারা পৃথিবীতে নেই এবং তোমার প্রতি ও বাংলা ভাষার প্রতি সেই যুগল ভালবাসা থেকেই আমার লেখার জগতে আসা। আমি চেয়েছিলাম ঘৃণার যে শেষ দৃষ্টিপাত আমার প্রতি তুমি করেছিলে সেটাকে আমি বদলে দেব চিরতরে। আমি পড়াশুনো করতে গিয়ে ধীরে ধীরে বুঝেছি বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে আমি যদি বাইরে বের না হই তাহলে বর্ষার প্রকৃতির সুন্দর রূপ আমি কোনদিনই দেখতে পাবো না… এর জন্য ছাতা আছে…ছাতা মাথায় দিয়ে বের হতে হবে। তাহলে জল ও গায়ে লাগবে না…. বর্ষার প্রকৃতির রূপও দেখা যাবে। ঠিক তেমনি কে আমার বৌকে মেয়েকে খারাপ চোখে দেখবে সেই ভয়ে যদি আমি তাদের বাইরে বের হতে না দেই, তাহলে তাদের ও কোনদিনই প্রগতি হবে না…. খারাপ যারা তাদের আটকানোর জন্য আইনের ছাতা আছে…বুদ্ধির ছাতা আছে.. চরিত্রের ছাতা আছে…চিন্তা কি…?”

শীলা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সুভাষের দিকে…. শুনছিল তার কথাগুলো। শীলার নিজের অজান্তেই কখন তার চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমেছে সে নিজেও টের পায়নি। শীলা অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে – একটা মানুষের এত পরিবর্তন হতে পারে? হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে সুভাষকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তার।

“ আমার ছেলেটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে, ও কোথায়?”…একটু থেমে হঠাৎ সুভাষ প্রশ্ন করে।

শীলা কোনো উত্তর দিল না। শুধু তার ডান হাত দিয়ে বিকর্ণের বাঁ হাত স্পর্শ করল। গাড়ী এসে থামল বিকর্ণের হোটেলের সামনে। শীলা অবাক হল- পাশের হোটেলটাই তার। সুভাষ যে তার পাশের হোটেলেই আছে সেটা জানত না শীলা। গতকাল থেকে তারা পাশাপাশিই আছে। হয়ত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের এ এক গভীর ইঙ্গিত।