বাঁচা 

– বলছি বিয়ে টিয়ে করেছো ?
– নাহ
– বলো কি তোমার মতো এলিজিবল ব্যাচেলর!
– সবার কি আর সব কিছু হয় স্যার ?
আমার নাইটহুড নেই তাই স্যার বললে বেশ অস্বস্তি হয়।  ইংল্যান্ডে দেখেছি বৃদ্ধ প্রফেসরকেও নাম ধরে ডাকে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি আলাদা। তাই হজম করে নিয়েই বললাম
– কেন ?
বি ফার্ম করে অসীম এখন মাল্টিন্যাশনাল ওষুধ কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। ক্লিন শেভেন, ফর্সা , সুঠাম মুগুর ভাঁজা চেহারা।  সেই মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় থেকে দেখছি।  এ কোম্পানি ছেড়ে ও কোম্পানি জয়েন করলেও আমি দেশে ফেরার পরেও আমার সাথে রেগুলার দেখা করতে আসে।  কালে ভদ্রে ওর ওষুধ লিখতে হয়।  ও নিজেই বলেছে আমার সাথে শুধু হ্যালো করতেই আসে।  পেশেন্ট দেখা শেষ। আজকে উপায় নেই।  চেম্বার-বন্দী দুজনে।  বাইরে বৃষ্টি হয়ে জল দাঁড়িয়ে গেছে। কালবৈশাখী চলছে।
– স্যার , আঠারোতে ব্লাড ক্যান্সার হয়। বেশ কবছর যুদ্ধ চললো। চুল গেলো। হাত পা শুকিয়ে কাঠি। দাঁড়াতে পারতাম না।  খরচের ঠেলায় বাবা বাড়ি বিক্রি করে  দিলো। জীবন তো পেলাম স্যার।  কিন্তু ক্লাস এইট থেকে যার সাথে প্রেম ছিল সে আর এলো না।  তবে আমাকে দেবদাস ভাববেন না।  কোম্পানি জয়েন করার পর প্রমোশন পেলাম।  তার পরে বাবা মা অনেক চেষ্টা করেছে।  কিন্তু ক্যান্সার শুনে সব মেয়ের বাড়ি থেকে পিছিয়ে গেছে। ক্যান্সার ছোঁয়াচে তো !
বললাম – ছোঁয়াচে ! সব গাঁজাখুরি ধারণা।
অসীম বললো সে তো আমি আপনি বুঝছি , সবাই বুঝছে কি ? তবে আমি এই ভালো আছি।
চেম্বার থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। ঝড় থেমে গেছে।  আকাশ বেশ মেঘলা।  তখনো।

২৬ বছরের কম্পারেটিভ লিটারেচার এর গবেষিকা। কেশবপুর য়ুনিভার্সিটির টিচারদের  নয়নমনি। মেধাবীনি।  ছাত্র মহলে হাসাহাসি চলে তাকে নিয়ে। কোনোদিন কোনো ছেলের সাথে সে কথা বলতে চায় না।  যেখানে ছেলে সেখানে সে নয়।  আস্তে আস্তে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।  কলকাতায় মামা বাড়ি।  মামা অনেক চিন্তা করে নিয়ে গেলেন সাইকোলজির কাউন্সেলর এর কাছে।  উনিও বললেন মেয়ে তো একদম ঠিকঠাক। এদিকে মামা মামিমার প্রেসার যাচ্ছে বেড়ে।  মেয়ে বললো অযথা , চিন্তা করো না।  আমি ঠিক আছি।  মায়ের ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ার পর কি হয়েছিল মনে নেই ? মা কে ছেড়ে চলে যায়নি বাবা?  মায়ের কলেজের কলিগ রা মায়ের পাশের চেয়ার এ বসতো না। শঙ্করদার বৌভাতে টিকলি যখন মায়ের কোলে উঠেছিল তখন সুধামাসী নিজের মেয়ে কে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়নি? এক প্যান্ডেল লোকের সামনে মা কে অপমান করেছিল যে ক্যান্সারের রুগী হয়ে কেন বাচ্চাকে কোলে নেওয়া ? কেউ প্রতিবাদ করেনি।  তারপরদিন রাতে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে মায়ের গাড়ি দুমড়ে পড়েছিল – আমাকে বুঝিয়েছিলে এক্সিডেন্ট !  যে মা গাড়ি চালিয়ে এলাহাবাদ চলে যেত, সে রাত ১ টায় ফাঁকা সেন্ট্রাল এভিনিউ এ থেমে থাকা ট্রাকে ধাক্কা মারবে অমনি অমনি ? ছেলে ভোলানো ? ভুলে গেছো? এই তো তোমাদের সমাজ।  তাই আমি ভালো আছি।  আমারও যে কোনো দিন ক্যান্সার হবে না তার কোনো যুক্তি আছে ? বাড়তি কোনো সম্পর্কের বোঝা আমাকে আর দিতে চেয়োনা।

আমাদের ক্যান্সার ওয়ারিয়র এর কাহিনী অনেকক্ষেত্রেই এরকম। ডাক্তারি ভাষায় তাঁদের বলা হয় ক্যান্সার সার্ভাইভার।  শুধু ক্যান্সার আক্রান্তরাই নন , তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও বৃহত্তর অর্থে সার্ভাইভার।  এবছর জুনের সাত তারিখ ক্যান্সার সার্ভাইভার ডে।  তাঁদের যুদ্ধ কিন্তু শুধু ক্যান্সারের সাথে লড়া নয়।  ঘরে বাইরে জীবনের অনেক অদৃশ্য শত্রুর সাথেও তাদের যুঝতে হয় নিরন্তর।

লড়াই টা শুধু রোগের বিরুদ্ধে নয়।
কোরোনা-কালে কঠোর লকডাউন এর মধ্যে সন্ধ্যে ৬ টায় ফোন বাজলো :
– ডাক্তারবাবু আজকেও আসতে পারলাম না
– হ্যাঁ, আপনার তো ১১ টায় আসার কথা ছিল, কি হলো ?
– আর বলবেন না, ৫ হাজার দিয়ে কোনোক্রমে ট্যাক্সি পেলাম তাও উত্তরপাড়া পেরোতেই পাংচার!
হুগলি থেকে কলকাতা ৫ হাজার? আঁতকে উঠি আমি।
– শুধু তাই না, ৪ ঘন্টা রোদে বসে ঘেমেছি। একটা জলের দোকান-ও খোলা ছিল না।  আপনার পেশেন্টের আজ খুব কষ্ট হয়েছে।
আস্বস্ত করে বলি, নাহয় অন্য একদিন আসবেন।
এবার এলো অমোঘ প্রশ্ন
– ডাক্তারবাবু, এই যে দেরি হচ্ছে, ক্যান্সার বেড়ে যাচ্ছে না তো ?
উত্তরটা আমি জানি। উত্তর টা তিনিও জানেন। মানুষ কে শৃঙ্খলার বেড়ি পড়ানো যায় কিন্তু অসুখ জানে না লকডাউন কি !

লড়াই টা ট্যাক্সি ধরায়। লড়াইটা জীবনদায়ী ওষুধের জন্য ঠা ঠা রোদে ওষুধের দোকানের সামনের লাইনের।  লড়াইটা ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে সরকারি লাল ফিতের বাঁধন পেরিয়ে দরকারের চেয়ে অর্ধেক মরফিন ট্যাবলেট হাতে পাওয়ায়।  লড়াইটা হাসপাতালে আসার জন্য বাসের উঁচু পা দানি তে পা না রাখতে পারার কষ্টে।  লড়াইটা ধস্তাধস্তি করে ১০ সেকেন্ডে লোকাল ট্রেনে উঠতে না পারার কষ্টে।  লড়াই টা এই যে, এই লড়াইটারই কোনো স্বীকৃতি মেলে না, তার হতাশায়।

তবে লড়াইটা কিন্তু সব সময় নেতিবাচক নয়।
পাঁচ বছর ধরে একটা মুখ দেখে যাচ্ছি।
সে মুখে কষ্ট দেখা যায় না।
সব সময় স্মিতহাসি। যা বলবো তাতেই হ্যাঁ।
ব্লাড টেস্ট করতে বললে
– করেগা স্যার,
স্ক্যান করতে বললে
– লে আয়েঙ্গে স্যার
এই যে ওষুধ টা দিলাম সেটা কিন্তু সব জায়গায় পাওয়া যায় না
– ঢুন্ড লেঙ্গে
আজকে আমি চেম্বার করতে পারবো না
– কোই বাত নেহি , কাল আয়েঙ্গে
বৌয়ের জন্য সব করছে সে ৫ বছর ধরে নয়।  ২০ বছর ধরে।
পাঁচ বছর ধরে আরো একটা মুখ দেখে যাচ্ছি।
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই সে আমাকে জিজ্ঞেস করে – ক্যায়সে হ্যায় আপ ?
নানা প্রশ্ন :
– ডক্টর হাম সাদী মে যা সকঙ্গে ক্যা ?
– হ্যাঁ হ্যাঁ কেন পারবেন না
– লেকিন ডক্টর, টয়লেট লাগ্ জায়ে তো ক্যা হোগা, হামকো তো আধা ঘন্টা লাগতে হ্যায় টয়লেট পে
এবার উত্তর স্বামীর – ও মত সোচ, হাম ও সব সামাল লেঙ্গে
২০ বছর ধরে লড়াই চলছে, রিপোর্টে দেখেছি ৮ বার অপারেশন হয়েছে।
পাঁচ বছর ধরে আর-ও একটা মুখ দেখে যাচ্ছি।
এটা তাঁর শাশুড়ির
আর্থরাইটিস এর পা টেনে টেনে হাসপাতালে আসেন কিন্তু চেম্বারে ঢোকেন না।  বৌকে প্রাইভেসী দেবার জন্য।  কিন্তু আমি এখন জানি নিয়ম মেনে শেষ পাঁচ মিনিট উনি আমার সাথে কথা বলবেন। কেন বলবেন তাও জানা। প্রতিদিন উনি বৌকে নিজে হাতে রান্না করে দেন।
উসকো মুলি কি সবজি দে সাকতে হ্যায় কেয়া ? সরসো কি সাগ্ ? জীরা দেনে মে কোই তকলিফ নেহি হোঙ্গে তো ? ওহ কব ঠিক হোঙ্গে ডক্টরসাব ?
সবাই ভালোই জানেন যে উনি পুরোপুরি আর কোনো দিন ভালো হয়ে যাবেন না।  কিন্তু স্বামী আর বাড়ির প্রতিটি লোক দাঁতে দাঁত চেপে অপরিসীম ধৈর্যের সাথে সে লড়াই জারি রেখেছেন – তখন মনে মনে কুর্নিশ না জানিয়ে পারি না। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে এই অসম লড়াইয়ে স্বামী কে ইতস্তত করতে দেখিনি কোনোদিন।

ক্যান্সারের চিকিৎসা আগে থেকে অনেক উন্নত এখন।  শুধু বাঁচা নয় ভালোভাবে বাঁচাটাও এখন বাস্তব। সাফল্যের অসংখ্য ছবি।  মুক্তির আকাশ অনেক বড়ো এখন। কিন্তু প্রত্যেকের জানা দরকার পুরোটা কাহিনী।  নাহলে দেশ – সমাজ এগোবে না। আত্মতুষ্টির বেড়াজালে আটকে থেকে ভবিষ্যৎ উন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাবে।

সাফল্যের জয়গান করার জন্য লেখনীর দরকার নেই। এই পৃথিবী শুধু সফল কাহিনীর কুশীলব দের- ই মালা দেয়।  ক্ষুরধার কর্পোরেট জগতে ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে খবর পরিবেশন করা হয়।  কিন্তু মোমবাতির তলাতে থাকে অন্ধকার। তার খবর কে রাখে ? এই অসম লড়াইয়ে মাঝে মাঝে সামিল হতে হয় চিকিৎসকদেরও।  চেম্বারে বসে স্ক্যান রিপোর্ট দেখতে গিয়ে যখন দেখি ক্যান্সার ফিরে এসেছে।  সামনে পেশেন্ট বসে রয়েছেন চোখে আশা নিয়ে যে ডাক্তার ভালো কথা বলবেন। পরবর্তী কথা বার্তার গতি প্রকৃতি বিশ্ববিখ্যাত কোনো চিত্রনাট্যকারেরও অজানা। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং যত্ন কে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় আগ্রাসী মারণ রোগ।  চোয়াল শক্ত করে চিকিৎসক কে হজম করতে হয় পরিণতি কে। চোয়াল শক্ত করে বেঁচে থাকার নামই সারভাইভাল।  সে রোগীই হোন কি চিকিৎসক। রোগের ব্যাপ্তি ছাড়িয়েও জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে একথা সমান ভাবে প্রযোজ্য।

ভেবে দেখুন আপনি যদি ডাক্তার নার্স বা ক্যান্সার পেশেন্ট নাও হন, আপনিও কোন না কোন যুদ্ধের সার্ভাইভার।  হয়তো আপনি অনেক পরিশ্রম করে কাজ করলেও পদোন্নতি হচ্ছে অন্য কারো।  আপনি প্রাইভেট টিউটর , আপনার জন্য ভালো রেজাল্ট হচ্ছে আর নাম হচ্ছে স্কুলের।  এতো আকছার দেখছি। সকালে বাড়ির বাইরে বেড়োনো  থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় বাড়ি ঢোকা পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো যুদ্ধের শরিক।

ঘরে বাইরে অসংখ্য যুদ্ধের সার্ভাইভার আপনি।  তবু আপনি চাইবেন না আপনার যুদ্ধটা অন্য কেউ এসে লড়ে দিক।  আপনি শুধু চাইবেন আপনার যুদ্ধকে আশেপাশের সবাই সহমর্মিতার সাথে দেখুক। আহা উঁহু নয়,  সহানুভূতি নিষ্ফল। কিন্তু সহমর্মিতার একটা গঠনমূলক ইতিবাচক দিক আছে।
বিশ্বজুড়ে এই সার্ভাইভার দের অধিকার নিয়ে অনেকেই সরব হচ্ছেন। তার মধ্যে নাট্যকার দের গ্রুপ থেকে কোনো কোনো দেশের সরকার সবাই রয়েছেন।  আমাদের দেশে চোখে পড়ার মতো এরকম আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ অপ্রতুল।  এতটাই কম যে, আছে কি নেই তাও বোঝা যায় না। যা দেখছি, সমাজের এই ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাবের সাথে রোগী বা রোগিণীর পরিবারের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ধর্ম, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা শহর গ্রাম ভেদ নেই।

সারভাইভাল একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা। প্রতি মুহুর্তের যুদ্ধ। সারভাইভ করার থেকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপট রচনা করে সার্ভাইভারশিপ। শুধু বাঁচার তাগিদে বেঁচে থাকা নয় ভালো ভাবে বেঁচে থাকাও এক মূল্যবান কৌশল। শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের ভালো রাখাও হোক আমাদের জীবনবোধের অন্যতম অঙ্গ। আশেপাশেই, পাড়ায়, অফিসে, স্কুলে, কলেজে এরকম অনেককেই আপনি পেয়ে যাবেন। আমাদের সামান্য সময় এবং মনোযোগ, আমাদের  অগোচরে হয়ে উঠতে পারে আরেকজন মানুষের  কঠিন সময়ের আশ্রয়। আসুন, জীবন উদযাপনে আমরা শরিক হই একে অপরের।