ফেরারী মন

রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে কোলকাতা থেকে রায়গঞ্জ ফিরছি। ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে ” অন্তহীন ” ছবির ‘ফেরারী মন ‘ গানটি শুনলাম।দারুন গান। ফেসবুকে গানটি শেয়ার করে দিলাম। সাথে সাথেই হঠাৎই এক পুরোনো বন্ধুর ফোন।বলছে “তুমি কি এবার ‘মন’ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছ নাকি?” হাসলাম। ভাবলাম একবার বলি ‘ মন’ নিয়ে গবেষণা তো অনন্ত, অসীম। এ তো শুধু আমার নয়! ‘মনে’-র বিস্তার তো দিগন্ত জুড়ে । ‘মন’ নিয়ে সবাই আমরা গোচরে অগোচরে কতই না গবেষণা করে চলেছি । কতরকম Experiment ! তাই মনের রকমারি দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতেই পারে।

একটা প্রশ্ন মাঝে মাঝেই মাথায় উঁকি দেয় । ‘মন’ কে কি বাগে রাখা যায় ? কঠিন এক প্রশ্ন । ‘মন’ তো আর কঠিন বা নরম কোনো পদার্থ নয় যেটাকে ধরে বেঁধে একটা আকার দেয়া যাবে!বেঁধে রাখা যাবে! ‘মন’ তো ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট’! ধরা ছোঁয়ার বাইরে। গান শোনেননি? ‘আমার হাত বান্ধিবি , পা বান্ধিবি , মন বান্ধিবি কেমনে?’ সত্যিই তো, ‘মন’ কে বেঁধে রাখা যায় না ।
মহাজ্ঞানী যোগী- রা তো অনেকদিন আগেই ‘মন’ কে বাগে রাখার অনেক উপায় বাতলেছেন। কিন্তু কাঁচকলা! সত্যিই কি বাগে আনতে পেরেছেন ‘ওনাকে’? মনে হয় না।
রবীন্দ্রনাথের রচনায় ‘মনে’ র বিচরণ রয়েছে অসাধারন, অদ্ভুত ভাবে । ” সখী ভালোবাসা কারে কয়। সেকি কেবলি যাতনাময়”!
এর রহস্য বড়ই সাংঘাতিক।

এই ধরুন প্যারিসের বিখ্যাত রেস্তরাঁ ‘ক্যাফে দি ফ্লোরে’ র ‘বার’ এ ‘হাবি’ র সাথে এক পেগ ড্রিঙ্ক নিতে নিতে হুশ করে আপনার ‘মনটা’ উড়ে চলে যায় গ্রামের আলখেতে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া সেই মলিন হাসির বন্ধুর কাছে ! কত কথা ছিল ওর সাথে !…..অন্তহীন । কথা শেষ হয়নি।আর হবেও না!

হুঁ হুঁ বাবা বেঁধে রাখতে পারবে নাকি ‘মন’কে? অনেক গবেষণা হয়েছে। অনেক মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে কিন্তু বেয়াদব ‘মন’ কে বাগে মানানো যায়নি।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে ‘মন’খারাপ আর ডিপ্রেশন দুটো এক জিনিস নয়। দিনে অনেক বার আমাদের ‘মন’ ভাল আর অনেক বার ‘মন’ খারাপ হতেই পারে। কিন্তু ডিপ্রেশন আবার অন্য জিনিস ।ডিপ্রেশনের তাও অসুধ আছে।’মন’ খারাপের কোনো ট্যাবলেট নেই। ‘মন’ খারাপ তো হবেই। ওটাকে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। মহাজ্ঞানীরা বলেছেন ।

যাইহোক পড়াশোনায় ‘মন’ বসানোর কথা খুব শুনতে হয়। কি মুশকিল । কি ঝামেলা ! তাইনা? ‘মন’ পড়াশোনায় কখনো বসে, আবার বসে না। জোড় করে বেঁধে বসাতে চাই কিন্তু কি মুস্কিল!একজায়গায় থাকেই না। উল্টে মায়ের বকুনি , বাবার চোখ রাঙানি । ইত্যাদি । ইত্যাদি । কিন্তু কারুর কারুর আবার পড়াশোনাকেই এত ভাল লাগে যে ‘মন’ যেন আস্টেপৃষ্টে বইয়ের সাথেই লেগে থাকে। ‘মনে’র কীর্তি! বড়ই অদ্ভূত ।

‘মন’ খারাপের কোনো শেষ নেই ! এই ‘মন’ ভালো তো এই ‘মন’ খারাপ! নিজের পছন্দ মতো ব্যাপার গুলো হলনা।ব্যাস ‘মন’ খারাপ! দুনিয়ার সবাই বাজে আর পাজি।আবার পছন্দসই জিনিস গুলো হচ্ছে দেখেই যে ‘মন’ ভাল থাকবে এমনও নয়। মানে মন খারাপের পাল্লা বেশী ।

এই প্রসঙ্গে বলি মৃত্যু, হতাশা, একাকিত্ব, এক্সপেক্টেশন, অসুস্থতা,ঝগড়া, অভিমান, রাগ ইত্যাদি সব কিছু নিয়েই ‘ আমাদের ‘মন’ খারাপ থাকে । আবার মন ভালো রাখার রসদও রয়েছে!

‘মন’ খারাপ এবং ‘মন’ ভালো এই দুটো নিয়ে ব্যালেন্স করে সকলে চলেছি। ‘মন খানি চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।’

শিশুদের মনখারাপ হয় যখন তারা দেখে তারই মতো আর এক শিশু শীতের রাস্তায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে।আমরা কি তখন ওর চোখের দিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করি? অনেক কারনেই শিশুদের মন খারাপ করে। আমরা জানতে চাই কি?

তা বাপু ‘ মন ‘ যখন ভগবান দিয়েইছেন খারাপ হলই বা! তাতে কি? ভালোও তো হয় !

ভালো হয় মানে ? দারুন ভালো হয় যখন দেখি খাবারের প্লেট ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছে! আর প্লেটে রয়েছে আমার প্রিয় ” তিলের নাড়ু”। মন খুব ভাল হয়ে যায় বুঝলেন। আনন্দে প্রানটা নেচে ওঠে।

রায়গঞ্জের লাইনবাজারে প্রায়ই দেখি এক থুত্থুড়ে বুড়ি ‘ ডালের বড়ি ‘ বিক্রি করেন । শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুতেই ফোকলা মুখে একগাল হাসি। ব্যাস আমারও ‘মন’ আনন্দে একেবারে ডগমগ। বুড়ি কে বলি ” কি বুড়িমা সব ঠিক তো? “

আচ্ছা মন খারাপ তাহলে কেন হয়?

ধূর ছাড়ুন তো। মহাভারতের যুদ্ধক্ষেত্রে ‘ অর্জুনের কি ‘মন’ খারাপ হয় নি? তারপরেই তো ‘গীতা’ এসেছে নাকি! তাই মাঝে মাঝেই ‘মন’ খারাপ হওয়া ভালো।

কি কি বিষয়ের ওপরে মন খারাপ করে? সন্তানের জন্যে মন কেমন করে। শহরের বাইরে থাকলে নিজের শহরের জন্যে মন কেমন করে।খুব প্রিয়জনের জন্যে মন কেমন করে। ট্রেনে যেতে যেতে পুরোনো কথা ভেবে মন কেমন করে!মায়ে র জন্যে মন কেমন করে। বন্ধুর জন্য মন কেমন করে। বান্ধবীর কথা ভেবে মন কেমন করে।আরও কত কি ভেবে মন খারাপ করে! ‘মন’ খারাপের শেষ নেই। কে কি বলেছে, কে কি ভেবেছে, ‘কাকে’ চিলের কান নিয়ে গেছে, অমুকবাবু আমার নামে ঐ কথা বলেছে। বলতে বলতে ডিগবাজি খেয়েছে। কত কি! ভেবে ভেবেই রাতকাবার , দিনকাবার আর ‘মন’ খারাপ!

যাচ্ছেতাই হল এই ‘মন’। এই ‘রাগ’ তো এই ‘অনুরাগ’। ‘মন’ কে বাগে মানাবে কে?

কোনো কোনো সময় ‘মন’ আটকে যায় নাচে, গানে, হুল্লোড়ে আর ফ্যাশনে। মনের আর কি দোষ? আটকাবেই। কিন্তু সবসময় কি ভালো লাগে নাচ গান?

মাঝে মাঝে খাদ্যরসিক লোভী মন ছুটে যায় প্রানকাড়া ল্যাংচা, হায়দারাবাদী বিরিয়ানি অথবা পায়েসের দিকে! খাবারের ব্যাপারে ‘মন’ খুব সচেতন!

কোনো কোনো সময় উরু উরু ‘মন’ উদাসী হাওয়ায় উড়ে চলে। খুব ঠান্ডায়,কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি হাওয়ায় অথবা বৃষ্টির ভাঁজে আটকে পড়ে ।কিশোর কুমার আর জুবিনের গানে ঘুরপাক খায় ।

‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’ আর গ্রামের পুকুরের সেই ছায়াঘেরা দুপুরের মাঝে ‘মন’ যেন আটকে থাকে।কাকে খোঁজে? ছোটোবেলা?আহা! ছোটোবেলাটা কি ভালো ছিল!

তাই ‘মন’ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতেই থাকে।চলবেও। প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত । সতেজ ‘মন’ বেঁচে থাকুক! সত্যজিতের ‘সিধু জ্যাঠা’ র মতো বলুক “মনের জানালাগুলো খোলা রেখো হে ফেলু মিত্তির।”

‘ফেরারী মন’ তৈরী হয়ে নাও। নতুন বছর আসছে কিন্তু !