নুন

কিন্তু শক খেলাম ২০০২ সালে।

দু মানুষ উঁচু আর তিন মানুষ চওড়া। কিলোমিটার হিসেবে লম্বায় প্রায় কলকাতা থেকে আগ্রা। পুরোটাই ঘন কাঁটাগাছের বেড়া। যে কাঁটাগাছের বেড়া তৈরি করতে ব্যয় হয়েছিল অনেক পরিশ্রম।

১৮৬৯ সালে শুধু দেড় হাজার টন কাঁটাগাছ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে গিয়ে এই বেড়া তৈরি করা হয়েছে ।

কয়েক হাজার সেপাই অতন্দ্র প্রহরায় রয়েছে যাতে এই কাঁটাগাছের বেড়া পেরিয়ে কেউ একশো গ্রাম লবণও এদিক থেকে ওদিকে না নিয়ে যেতে পারে।

অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে তো?

দাঁড়ান, দাঁড়ান! ব্রিটিশ শোষণের গল্প কি শেষ হওয়ার?

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কলোনিয়াল ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের  তৈরি এই গ্রেট হেজ অফ ইন্ডিয়া (great hedge of India ) ব্রিটিশ শাসনের আরেক ক্রুর ইতিহাস তুলে ধরে আমাদের সামনে।

২০০২ এ ইংল্যান্ডের এক গবেষক রয় মোক্সাম যখন এই লুকিয়ে রাখা ইতিহাস সবার সামনে তুলে আনেন, না ভারত না ইংল্যান্ড – কোন দেশই প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি এর অস্তিত্ব।

ইংল্যান্ডের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কলোনিয়ালিজমের কয়েকশো বছরের নিষ্ঠুর ইতিহাস নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, সেই কবেই।

যে ব্রিটিশ সরকার এখন মানবতার ধ্বজাধারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায় অহরহ, তারা যে কি জঘন্য কার্যকলাপ চালিয়েছিল একসময় সারা পৃথিবী জুড়ে, তা কি তারা ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্বীকার করতে পারবে ?

আর ভারত ? সেই কাঁটাগাছের চওড়া সরকারি জমিতে তৈরী করেছে পিচের রাস্তা। রাস্তা তৈরির আগে সেখানে যে কি ছিল, তার কোনও দলিল রাখার প্রয়োজন মনে করে নি।

আশেপাশের বসতির মানুষ জনের মনে কাঁটাগাছের দেওয়ালের স্মৃতি ছিল প্রখর।  কিন্তু তাঁরা লিখতে পারতেন না।  তাই তাঁদের মৃত্যুর সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছিল এই নুন-বেড়ার ইতিহাস।

লন্ডন মিউজিয়ামের রেকর্ড-কিপার রয় মোক্সাম। ১৯৯৫ এ লন্ডনের ধুলোমাখা পুরোনো বইয়ের দোকানে আবিষ্কার করলেন এক ছেঁড়া চটি বই। ১০০ বছরেরও আগে লেখা স্লীম্যান নামের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সৈনিকের।

১৮৫০ এর স্লীম্যান নুন খেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের, কিন্তু ভালোবেসেছিলেন ভারতকে। তাঁর বইয়ে তিনি লিখে রেখে যান ভারতের অনেক ভুলে যাওয়া ইতিহাস। লিখেছিলেন এই নুন-বেড়ার যন্ত্রণার কথাও।

লন্ডনের বইয়ের দোকানের গলিতে দাঁড়িয়ে রয় মোক্সাম বজ্রাহত – একি দেখছেন তিনি ? স্বপ্ন না সত্যি। টাকাপয়সা জোগাড় করে চলে এলেন ভারতে।

লন্ডন আর ভারত- প্রায় ডেলি প্যাসেঞ্জার হয়ে গেলেন তিনি। আর্কাইভ ঘেঁটে, পুরোনো ম্যাপ তন্নতন্ন করে খুঁজে আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্যে শেষে প্রমাণ করে ছাড়লেন ভুলে যাওয়া ইতিহাস। ২০০২ এ প্রকাশিত হলো তাঁর সেই বই The Great Hedge of India: The Search for the Living Barrier that Divided a People.

ইতিহাস বলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা, বিহার, উড়িষ্যা আস্তে আস্তে দখল করার পরে তাদের নজর পড়ল সাধারণ মানুষের পাতে দেওয়ার লবণের উপরে। পূর্ব ভারতের লবণ তখন শুধু কলকাতা, পার্শ্ববর্তী অঞ্চল এবং উড়িষ্যার উপকূলে তৈরি হতো।

বেশিরভাগ লবণই তখন উনুনে জ্বাল দিয়ে জল শুকিয়ে তৈরী করা। ব্রাহ্মণরা তো আবার জাঁক দেখিয়ে রান্না করা লবণ খাবেন না !

ক্লাইভ বললেন, এস বৎস আমার ফাঁদে পরো। আমিও এট্টু লাভ করি।  খুব সুচতুরভাবে সমুদ্রের জল শুকিয়ে তৈরী ‘না-রান্না লবণের’ ওপর ট্যাক্স বসলো।

কারখানাগুলো মনোপলাইজ করে দেওয়া হল এবং নিয়ম করা হলো তারা তাদের ইচ্ছামতো ব্যবসায়ীদের কাছে লবণ বিক্রি করতে পারবে না। যদি বিক্রি করে তাহলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা তার অনুমোদিত কোন এজেন্সিকেই বিক্রি করতে হবে।

আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই বিক্রি হওয়া লবণের উপর বসাবে চড়া কর।
কিন্তু গোল হলো অন্য জায়গায়, এতকিছু সাজসরঞ্জাম করেও যথেষ্ট ট্যাক্স উঠছে না।

ইংল্যান্ডেও যথেষ্ট টাকা পাচার করা সম্ভব হচ্ছে না। কি লজ্জা, কি লজ্জা!
দেশে ফিরে পার্লামেন্টে মুখই দেখানো যাচ্ছে না।

তখন ইংরেজদের টনক নড়লো।

ও হরি ! পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাট থেকে লবণ আয়াশে চলে আসছে মধ্যপ্রদেশ আর পূর্ব ভারতে। কী করা যায়?

কেন? ভাগ করতে ইংরেজদের থেকে আর কে ভালো পারে ?

অতএব ভাগ করে দাও দেশ। ধর্ম নিয়ে নয় – তখনও ধর্মের নামে দাঙ্গা করতে আমরা ততটা উৎসাহী নই।  ভাগ হোক ট্যাক্স নিয়ে। কি সাহস!  বাংলাকে লবণ দেবে মহারাষ্ট্র?

হিন্দুস্থানের বুক চিরে দাও। অল্প কটা কাস্টমস চেকপোস্ট ছিল আফিমের জন্য।  কিন্তু এবার অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাব থেকে শুরু করে উড়িষ্যার দক্ষিণ পর্যন্ত প্রকান্ড এক দেয়াল ভারতের বুক চিরে আলাদা করে দিল ভারতবর্ষকে।

যাতে পশ্চিম ভারত আর লাহোরের খেওরা খনির সুবিখ্যাত হিমালয়ান সল্ট যাতে পূর্ব দিকের ভারতে ঢুকতে না পারে!  আর পূর্ব ভারত থেকে চিনি যাতে পশ্চিম ভারত আর অধুনা পাকিস্তানে কোনো মতেই না যেতে পারে।

তখন বই লেখে না বিশেষ কেউ। খবরের কাগজও নেই।

ইতিহাসকে বোবা করে রেখে নিঃশব্দে হলো এক পার্টিশন। ভারত-ভাগ।

ব্যাপারটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে চেপে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাধ সাধলেন স্লীম্যান আর রয় মোক্সাম – ঘটনা চক্রে দুজনেই ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ।

বইটিতে খুব সবিস্তারে লেখা হয়েছিল কিভাবে এই  দেওয়ালকে আরও মজবুত রূপ দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল ইংরেজরা।

১৮২৩ সালে ইঁট-বালির তৈরী পারমিট লাইন কিছু বছরের  মধ্যেই সংরক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছিল এখানে ওখানে।

তৎকালীন কমিশনার অফ কাস্টমস ছিলেন অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম।
এককালে বোটানি নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন হিউম।

খানিকটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই বুঝতে পারলেন ভারতে জন্মানো কাঁটাঝোপই এক দীর্ঘস্থায়ী, মজবুত, দেওয়ালের মত কাঠামো নির্মাণ করে ভারতকে দুভাগ করে ফেলতে পারে।
এই কাঁটা গাছের জঙ্গল সার-জল-খাবার বেশি চায় না। অযত্নেই সে বাড়ে ভালো।

কাঁটাঝোপের তৈরী দেওয়াল দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে বেড়ে উঠতেই,  মানুষের পাতে আবার অভাব হলো লবণের। বাধ্য হয়ে মানুষকে কিনতে হলো চড়া দামের লবণ।

কোল্ড ড্রিঙ্কস খাবার মতোই, স্ট্র দিয়ে ভারতীয়দের পকেট থেকে ইংল্যান্ডে অর্থ সরবরাহ চলতেই থাকলো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে যখন ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতের শাসনব্যবস্থা অধিগ্রহণ করে নেয় তারপরও রমরম করে চলেছিল এইসব ট্যাক্স।

ক্রুর, ধুরন্ধর ব্রিটিশ সরকার এরপরও ভারত শোষণে ক্ষান্তি দেয়নি এতটুকুও!

ভারতে যথেষ্ট ভালোমানের লবণের যোগান থাকলেও সুদূর লিভারপুল থেকে নিয়ে জাহাজে করে নিয়ে আসা হতো লবণ। ভারত থেকে তো ভর্তি-জাহাজ নানা উপকরণ নিয়ে ইংল্যান্ডের বন্দরে যেত।

কিন্তু ইংল্যান্ড থেকে ভারতে খালি জাহাজ পাঠাতে হচ্ছে। ইংল্যান্ড থেকে তো আনার তেমন কিছুই নেই। খালি জাহাজ এলে তো অনেক ক্ষতি।

অতএব চেশায়ার থেকে ওঠাও লবণ, ওঠাও ম্যানচেস্টারের কটন মিলের জামা কাপড়। লিভারপুল বন্দর থেকে জাহাজ ভর্তি করে পাঠাও ভারতে।

কিন্তু ভারতে সেসব বিক্রি হবেই বা কেন? ইংল্যান্ডের থেকে ভারতের লবণ তো অনেক  সুস্বাদু। লাহোর আর মুম্বাইয়ের লবণ তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিই ইংল্যান্ডে রফতানি করে। মসলিন আর তাঁতও তো সারা পৃথিবীতে রফতানি হয়।

হুঁ হুঁ , বাবা, অত্যাচারী ইংরেজদের বুদ্ধি কি কম!

ভারতের লবণে আকাশছোঁয়া কর বসাও যাতে লিভারপুলের লবণ কিনতে বাধ্য হয় ভারত।

আর ভারতের মসলিন আর তাঁত বুনতে যাতে না পারা যায় তার জন্য তাঁতীদের আঙ্গুল করে দাও ঘচাং-ফু। ক্রমশ ভারতের মসলিন শিল্পই অবলুপ্তির পথে হাঁটা দিল।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খুশি!
ব্রিটিশ গভর্নমেন্টও বেজায় খুশি!
খালি জাহাজ তো আনতে হলোই না উপরন্তু জাহাজের মাল বিক্রি করে অনেক টাকাই লাভ হলো।

ভারতের থেকে আসা লভ্যাংশ এতটাই তীব্র ছিল যে, ভারতবর্ষের ভাইসরয়ের বেতন ছিল ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বেতন এর চার গুণেরও বেশি।  তার পরেও সন্দেহ করা হয় ভাইসরয়ের মাসোহারার বেশি অংশ ছিল তাঁর বেতন বহির্ভূত।  টেবিলের নিচ দিয়ে।

তবে একটা দেশ বা একটা জাতি সম্পূর্ণ কালো বা সম্পূর্ণ সাদা হয় না।  খোদ ব্রিটেনেও অস্বাভাবিক লবণ ট্যাক্সের উপরে নানা বিতর্ক হয়েছে। ব্রিস্টলের চেম্বার অফ কমার্স থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টও সরব হয়েছে নুন-ট্যাক্সের অবিচারের বিরুদ্ধে।

তর্ক হয়েছে যে কেন ইংল্যান্ডের কয়েদিদের জন্য ধার্য করা ন্যুনতম নুনের থেকেও একজন গড়পড়তা ভারতীয় কম নুন পাবেন ?
যেখানে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে নুনের প্রয়োজনীয়তা একটু হলেও বেশি – কারণ এতটাই ঘাম ঝরে এখানে।

খোদ রাণীর কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে যে কি করে তাঁর রাজত্বে ইংল্যান্ডের থেকে ভারতে লবণের দাম ১৫ গুণ বেশি হতে পারে।
এই মহার্ঘ্য লবণের অভাবে ভারতের মানুষজন কিভাবে নানা অসুখের শিকার হচ্ছে!

কিন্তু না, ইস্ট ইন্ডিয়া থেকে আসা করের টাকার লোভ সামলাতে পারেনি কেউই।

….(ক্রমশঃ)