সমাজের চোখে গরীব আরও গরীব হলে এবং গরীবের গরীব হয়ে ভয়ংকর বংশ বিস্তারিত হলে কষ্টের সীমা থাকে না। অন্যদিকে সামান্য কয়জন বিপুল ধনী যারা হয়ে উঠলো, তারা কী করে ধনী হলো অথবা সেই ধনীদের পূর্বপুরুষ, মাত্র এক আনা পুঁজি নিয়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন,সাহস,ঝুঁকি নিয়ে যে নিরন্তর চেষ্টা করলো, সেই দিকে আরামের ও সম্মানের অবাক দৃষ্টি সমাজ কক্ষনো ফেলতে চায় না। কারণ গরীবের নির্ধন হওয়ার দুঃখের ঘটনার চেয়ে ধনীর তিল তিল করে ধন গড়ে তোলার দুরূহ প্রচেষ্টা নিয়ে ভাবা ও মেনে নেওয়া শান্তির নয়,সে অসহ্য এক বৈষম্যর ব্যাপার। সমাজ ভাবে ধনীর জন্ম হয় সৌভাগ্য ও অলৌকিক আশীর্বাদে, আর গরীবের জন্ম হয় ধনীর অভিশাপে ও অত্যাচারে। সমাজের চরম মিথ্যের এই অন্ধকার জ্ঞানের মধ্যে দিয়েই গরীব সহজে সমাজের চোখের জল আদায় করে।সে দয়া ভিক্ষাও পায়, সে দান পায়, সে ধার পায় এবং সে আরও কাঙাল হয়ে ওঠে। ওদিকে ধনীর ধনবৃদ্ধির পিছনে চিরন্তন প্রগতির মেধা,পরিশ্রমের রক্তাক্ত পায়ের ছাপের দিকে কারোরই নজর পড়ে না। সমাজ নিজের দুর্বল মানসিকতার একটি আয়োজন স্থির করে রাখে,যাকে নিয়ে ভাবলে তার উপকার হয় সে তার পাশেই আবেগের শূন্য ভিক্ষা নিয়ে দাঁড়াবে। গরীবের চিরকালের দুর্বলতা, অলসতা, স্বপ্ন দেখার অনিচ্ছাকে সারানোর চেষ্টা সে কখনোই করবে না আর ধনীকে নিয়ে ভাবলে ক্ষতির সম্ভাবনা, হিংসের উদগীরণ,লাভের আশাহীন ভাবনা। তাই সমাজ সেই ধনীর ধনীত্বের মুণ্ডুপাত করবে এবং ধনীর নিজের যোগ্যতায় ন্যায্য ধনী হয়ে থাকার ও নিরন্তর উন্নতির জন্য সমাজের মানুষের কাছে ঘৃণিত হয়ে থাকবে পরিসংখ্যানে চিরকাল।
গরীব যতই বাড়ছে, তার চেয়েও সমাজের দুশ্চিন্তা ও প্রবল রাগ এই যে ‘ধনী ও ধনীর ধন কোন রহস্যে কেন বেড়ে উঠলো’।
মানুষের ধনী ও দরিদ্র হয়ে ওঠার পথ চিরকালই খোলা। সেই পথে লক্ষ্মী ও অলক্ষ্মী বসে নেই, বসে থাকলে দেশে গরীব থাকতো না, ধনীও থাকতো না। সেই পথে সকলের জন্য রয়েছে নিরন্তর চেষ্টা,স্বপ্ন,ঝুঁকি,নিরাশা, উত্তুঙ্গ আশা ও পরস্পর কঠিন যুদ্ধের পথে যোগান হিসেবে অফুরান দমের হাঁটার প্রবল শক্তি। সেই পথের গিঁট বাঁধা সকল মানুষেরই দুই বাহুতে। যার গিঁট খুলে যায় সে দরিদ্রের দলে, যে গিঁট আরও শক্ত করে বেঁধে এগোয়, সেই ধনী। সমাজ এটাকে মানে না,কারণ এই বিপ্লবের নায়ক ধনী, তার বড্ড যেন আরাম এখন, তার বাগিচায় প্রচুর সম্পদফুল। ভিলেন হলো সেই দারিদ্র, যে বেচারার দুই বাহুতে ও মগজে দুর্ভাগ্যের বজ্রপাত। গরীবের দোষ ধরা হয় না তার দরিদ্র হওয়ার জন্য, কিন্তু ধনীর পরিশ্রমের ও বিপ্লবের যে ধন, সে যেন তার লুকিয়ে ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যখের ধন।
শহরে দু’টি মানুষ প্রবেশ করলো একসাথে। একজন প্রভূত লোকসান করে গ্রামে ফিরে গরীব হয়ে রইলো পুনরায় আর একজন ধনী হয়ে উঠলো, এই সমীকরণ সমাজের চোখকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলো। সমাজের প্ররোচনায় গরীব পুনরায় ধনীর কাছে এসে সাহায্য চাইলে ধনী তাকে একেবারে ফতুর করে ছেড়ে দিলো- এই গল্প সমাজঅন্ধরা খুব তুলে ধরে। ধনীর দেওয়া ধনের আসল পুঁজিকে গরীব দ্বিতীয়বার বাড়িয়ে তুলতে পারলো না নিজের অর্জিত আসল মূলধনের সম্বলে, কেবলই সুদ বাড়লো শুধু এবং গরীব গরীব রয়ে গেলো। ধনীর সন্তান ধনীর উপার্জনের উত্তরাধিকার পেলো সরল অধিকারে। আরও জটিল হলো যখন দরিদ্রের সন্তানও উত্তরাধিকার সূত্রে পেলো আরও দরিদ্র হয়ে ওঠার চরম দুর্ভোগ। সমাজ বুঝলো না কিছুতেই। ধনীর ধন শেষ হতে পারে ভোগে, রোগে, নানাবিধ জটিলতায়। অন্যদিকে দরিদ্রের শক্তি বেড়ে সে একদিন ধনী হতে পারে, এই ক্রিয়া দাঁড়িপাল্লায় মেপে সমাজে ঘটে না, হয় সামাজিক নীতি ও নিয়মের সঞ্চয় ও অবক্ষয়ের উপর।