ত্রিকোণ

  • “আমাকে হঠাৎ এইভাবে আসতে বলার কারণ!”
    “-কিছুই না,মিঠাইকে ভুলে যান, বিনিময়ে যা চাইবেন তাই পাবেন “
    -“কী বলছেন এসব !”
    -” তুই হ্যাঁ তুই আসার পর থেকে আমার মিঠাই আমার থেকে দূরে সরে গেছে , আমার জন্মদিন ভুলে যায় আজকাল ও ,আগে যা করতো না কখনও”
    -“তাতে আমার দোষ কি!আর এইভাবে তুইতোকারি করছেন কেন!”
    -“তুই ,শালা তুই না থাকলে এত কিছু হতো না।আমার, আআমার মিঠাই আমাকে ছেড়ে এইভাবে থাকতো না।ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড , কেড়ে নিয়েছিস আমার থেকে আমার মিঠাইকে। ডু ইউ নো হাও মাচ আই লাভ হার!শালা হারমি “
    -“হে আর্য ,মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ ,লিসেন বাডি , ডু ইউ নো সি লাভস মি!”
    -“সব জানি সব, কিন্তু নাহ এটা হবে না ,তুই তুই চলে যা ,বিয়ে ভেঙে দে, কিছু কিছু একটা বলে, আআমি আমি আবার ওকে সামলে নেবো,আগলে রাখবো, ও আবার আমার হবে হ্যাঁ”

চাপা আর্তনাদ ভেসে এলো ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে…

২.
সময় নদীর মতো বহমান ।গতিপথ বদলে দিলেই যে মজে যাবে তা নয় ও চলবে নিজের মতো করে।আর মাঝে মাঝে অনেকেই ভেসে যায় স্রোতে কেউ সাঁতরে ওঠে। সময় উদীয়মান সূর্যকে প্রণাম করে ডুবে যাওয়া সূর্যের চ্ছটা যে সবসময় দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠবে তা নয় ,টপ করে নেমে যাবে মেঘ করে থাকলে বালাই নেই আর ।ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পর্দার ফাঁক থেকে সোজাসুজি চোখ রাখলো দেয়ালে আঁটা ঘড়িটার দিকে । আঙুলের ফাঁকে গোল্ডফ্লেক কিং সাইজের একটা স্টিক ধীরে ধীরে প্রাণ হারিয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে।এইসময় ওর কিছু করার নেই কেবল ঘড়ি দেখো সিগারেট টানো আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে অপেক্ষা করো কোনো পরিচিত অপরিচিত কেউ এলো কিনা । আজকাল এই বাড়িতে কেউ আসে না বলা বাহুল্য এই ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে । এই ফ্ল্যাটে জনমানব বলতে বয়স ২৬ এর অনি ওরফে অনিমেষ সরকার একা। অনিমেষ পাঁচফুট নয় ইঞ্চির যুবক , খুব বেশী ফর্সা নয় হালকা শ্যামবর্ণ। মুখ ভর্তি কিছুদিনের না কাটা দাড়ি । চোখের নীচে কালো গভীর দাগ স্পষ্ট। অনায়াসে দেখে বলে দেওয়া যেতে পারে অবসাদে ভুগছে।
আরেকটা সিগারেট ধরালো ,আর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠলো ফাঁকা ফ্ল্যাটটা গমগমে আওয়াজে , ডায়নিং রুমের সোফায় ফোনটা। ফ্ল্যাটে একটা ডায়নিং রুম ,একটা বেডরুম আর রান্নাঘর আর বেডরুম লাগোয়া বাথরুম। ঘরটা যাই হোক ব্যালকনিটা বেশ চমৎকার পেয়েছে। আর যার জন্য ঘর নিস্তেজ থাকলে যেখানেই ফোন থাকুক আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুটা অলসতা কাটিয়ে তৎপর হয়ে ফোনটা ধরতে গেলো অনি। হাতে তুলে নিতে নিতে ফোনটা কেটে গেছে ,একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা নীচে রাখতে গিয়েও রাখলো না । স্ক্রিন জ্বলজ্বল করে মেসেজ ঢুকলো। টাচ করতেই মেসেজটা ভেসে উঠলো।

” ফোন করেছিলাম , ধরলি না। এত রাগ এত অভিমান থাকা ভালো না। কেউ কিছু বললে শুনতে হয় । তারপর বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে ” ।
পড়লো মেসেজটা সঙ্গে সঙ্গে পরপর আরও তিন চারটে মেসেজ এলো।
“যেখানে যেমন সেখানে তেমন ,এটা তোর শেখানো কথা ছিল। আজ তুই বলছিস সরে আসতে “

“আমি চলে যাচ্ছি তোর থেকে অনেক দূরে। অবশ্য তুই নিজে।ঠিক থাকলে আজ এমন দিন আসতো না”

“ভালো মানুষের মুখোশ পরে অভিনয়টা খুব ভালো করলি।তোর জন্য আজ আমার সবাই চলে গেলো।তোর জন্য আমার আদিল চলে গেলো, একমাত্র তুই দায়ী।”

” কখনও চাসনি ভালো আমার তাই নিতে পারছিস না । নিজের ক্লাস ভুলে গেলি তোর কি গুণ আছে যোগ্যতা আছে আমার বন্ধু হবার?গুডবাই ফরেভার “

” তুই চাসনি কখনও আর্য থাকুক আমার জীবনে। তুই কখনো কারো ভালো চাইতে পারিস না, আজকেও আর্য ফোন করলো না এখনো পর্যন্ত”

অনি বসে পড়লো সোফাতে ঢপ করে। ও চাইলে রিপ্লাই করতে পারে।প্রত্যুত্তরে অনেক কিছু বলতে পারে কিন্তু ও জানে আজ আর ওকে কিছু বলা উচিৎ না। মিঠাইকে আর আটকানো উচিৎ না। অনি এবার শান্তি চায় একটু।এতদিন বারবার অনি হাজার কথা শোনবার পরেও নিজের ভুল না থাকলেও রাগ কমাতো তার। কত অপমান সহ্য করে পড়েছিল এতদিন।

ও মুক্ত পাখি । ডিপ্রেসড থাকতে থাকতে এমন হয়েছিল যে যখন তখন যা খুশী বলতো।কত ঝগড়া চিৎকার তারপর আবার ঠিক হলে শান্ত মেয়ে। ওর সাথে যখন পরিচয় হয় অনির তখন প্রথমদিকে হতাশাগ্রস্ত মিঠাইকে অনির বুঝতে পারেনি ঠিক মতো।মিঠাই ওরফে শ্রেয়া ঘোষ , ২৬ বছর বয়সী তরুণী । উচ্চতা ৫ ফুট ৩এর , মাঝারি গড়ন, খুব বেশী সুন্দরী না হলেও ড্রেসিং সেন্স কথাবার্তা তার ব্যক্তিত্বকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

তখনই সবেমাত্র মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠছে অনিমেষ।মিঠাইয়ের হাত ধরতে চেয়েছিলো। অনি নিজেই ছোট থেকে ট্রমার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।তবুও ও যখন হঠাৎ ভালোবেসে ফেলেছিলো মিঠাইকে। তারপর থেকে আর সরে আসতে চায়নি । অথচ কত অপমান কত অবহেলা গত ৫বছরে পেয়েছে। হিসেবের কাছে মিঠাইয়ের অভিযোগ তুচ্ছ। অনি জানে মিঠাই এখন যেতে চায় তাই ছোট ছোট বাহানা খুঁজছে যাওয়ার। অনি একটা ফোন করলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ও কেন করবে! প্রতিদিন এক কথা এক ঝগড়ার বিষয় ভালো লাগে না। অথচ অনি কি কিছু করেনি? মিঠাই না চাইতেও এত বছর থেকে গেছে।বিভিন্ন সময়ে ওকে উত্যক্ত করেছে। মিঠাইয়ের কাছাকাছি এসেছে। মিঠাইকে কতবার উল্টোপাল্টা বলে দিয়েছে।সন্দেহ করছে কতবার।অথচ সন্দেহ কেন? অনি তো মিঠাইয়ের প্রেমিক নয়।মিঠাই প্রথমেই পরিষ্কার করে দিয়েছিল।সমবয়সী প্রেমে ও বিশ্বাসী নয়। আর্যকে ওর তারপর হঠাৎ মিঠাই ভালোবেসে ফেলে ওর কলিগ আর্যকে।

৩.
এই আদিল ছিলো মিঠাইয়ের প্রথম প্রেম। অনি আসার আগেই।এবং আদিল মিঠাইয়ের সবচেয়ে খারাপ অতীত। মিঠাইকে বিভিন্ন ভাবে টর্চার করতো। একদিন ক্লান্ত হয়ে মিঠাই আত্মহত্যা করতে যায় রেললাইনে তখন অনি সে রেললাইনে নিজেও গিয়েছিল আত্মহত্যা করতে। তারপর ওর পরামর্শেই আদিলের থেকে সম্পর্ক শেষ করে মিঠাই। এটা কি কোনো খারাপ হতে পারে কখনও? যেখানে আত্মসন্মান নেই সেখানে থেকে ভালোবাসা নেওয়া সবচেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ। ভালোবাসা আর যাইহোক এমন হয়না। পচনশীল ভালোবাসা ছেঁটে দেওয়াই ভালো সবসময়।কিন্তু এরপরেও শেষ হয়নি। মিঠাইয়ের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দেবে বলে আদিল মাঝেমধ্যেই মিঠাইকে ব্ল্যাকমেইল করতো এবং টাকা নিতো। কথাটা একদিন জানতে পারে অনি। তারপর আদিলের আর খোঁজ মেলেনি কখনও।

এসব ভাবতে ভাবতে সোফায় এলিয়ে দিলো শরীরটাকে অনি ।আবার একটা সিগারেট ধরালো।মাথাটা বেশ ধরেছে। শরীরের জামাটা খুলে নিলো।

গত ৬ মাস ধরে এই ঝগড়া চলছে । এই তিনমাসে একলাইন ও লিখতে পারেনি অনি।কেবল দিনকে দিন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।ও যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে মিঠাই ততটাই জুড়ে গিয়েছে আর্যর সাথে। লেখালেখি বন্ধ ফোন ধরেনা কারো শেষ একসপ্তাহ ধরে অফিস যায়না। আর সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে ও নেই শহরে। অনি যতবার মিঠাইকে জানিয়েছে ওকে ভালোবাসে ততবার মিঠাই এড়িয়ে গেছে। আর এই এড়িয়ে যাওয়াটাই অনি মেনে নিতে পারেনি।

তবুও চুপ থেকেছে। সেদিন ফিরবার পথে দ্যি প্ল্যানেট গ্যান রেঁস্তোরার পাশে পার্কিং লটে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। কালো রঙের গাড়িটির নম্বরপ্লেট দেখে অনি চিনতে পারে গাড়িটি কার। বাইক থামিয়ে লক্ষ্য করে। গাড়িটির বনেটের উপর বসা ব্ল্যাক স্লিভলেস শাড়ি পরা , চুলগুলো ডানদিকের কাঁধে এলানো একটি মেয়ে আর তার দুগালে সামনে থেকে জড়িয়ে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দিচ্ছে একজন ৬ফুট উচ্চতার ফর্সা, টিকালো নাক ,কালো কোট কালো প্যান্ট পরা একজন সুপুরুষ বলা যায় বটে। ছেলেটি আর্য। আর্যদের মতোই তার দেহের গড়ন। আর মেয়েটি মিঠাই।

শরীরে আর একটুও প্রাণ নেই মনে হলো অনির। ফ্যান চলছে ঘরে তবুও ঘামছে ও। দেয়াল ঘড়ি জানান দিলো অ্যালার্ম বাজিয়ে দুপুর দুটো বাজে।সিগারেট শেষ। সকাল থেকে একনাগাড়ে সিগারেট টেনে যাচ্ছে অনি। এবার উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। কফি এককাপ বানিয়ে ফিরে এলো।আজ আর রান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে না আর । খাওয়ার ইচ্ছেটাই যেন নেই আর। আবার এককাপ কফি আর সিগারেট টানতে টানতে। ফিরে গেলো সেই দিনটিতে।

চারপাশ দিয়ে বিভিন্ন লোক যাওয়া আসা করছে । এই অঞ্চলটায় পাশাপাশি অনেক গুলো রেস্টুরেন্ট হোটেল অবস্থিত।সবগুলো প্রায় থ্রীস্টার ফোরস্টার ক্যাটাগরির। অনি জানে এই জায়গায় এইসব স্মুচিং কোনো ব্যাপার নয় এখন।শহর বড়ো হচ্ছে,সভ্যতা এগোচ্ছে মানুষের মন ততটাই বিকশিত হচ্ছে।অথচ কিছুবছর আগে মেট্রো ট্রেনে এক কিশোরী এক কিশোরকে জড়িয়ে ধরেছিল বলে জনতা তাদের মেরেছিল।
আজ এই দৃশ্য। অন্যকেউ হলে হয়তো ওর এতটা খারাপ লাগতো না।কিন্তু এত খারাপ লাগছে কেন! নেহাত মিঠাইকে ভালোবাসে বলে ও নিতে পারছে না! ওর তো এরকম ছিলো না মানসিকতা! অনি জানে মিঠাই কোনোদিন ওকে ভালোবাসবে না তবুও ও চেয়েছিলো মিঠাইয়ের বিয়ে হোক ওর জীবনে নতুন কেউ আসুক। যদিও অনি ওকে ছাড়া আর কাউকেই কখনও ভালোবাসতে পারেনি তবুও। অনি সেও কি খুব একটা ভালো জায়গায় দাঁড়িয়ে! মুখে বলে মনেপ্রাণে মিঠাইকে ভালোবাসে মিঠাই খুশী থাকুক আনন্দে থাকুক ও চায়। কিন্তু
নিজেও তো দুদিন আগে দৈনিক সকাল খবরের কাগজের এডিটর যাকে ও দিদি বলে ডাকে সেই বিবাহিত সঙ্ঘমিত্রার সাথে তার ফ্ল্যাটে রাত কাটিয়ে এলো। সারারাতে তিনবার তারা সেদিন মিলিত হয়েছিলো।পরেরদিন সকালে সঙ্ঘমিত্রা তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ওর বুকের সাথে ঘন্টাখানেক লেপ্টে ছিলো। নিজে যা খুশী করতে পারে আর অন্যকেউ করলে মেনে নেওয়া যায়না ।পরেরদিকে সঙ্ঘমিত্রার আবদার অনুরোধ এত বেড়ে গিয়েছিল অনি নিতে পারতো না। স্বামী ছেড়ে পর্যন্ত চলে এসেছিল।

মিঠাইকে কখনও এমন ভাবেনি ও।মিঠাই এমন করবে ছিঃ। কোথাও তো অদৃশ্য ভাবে লেখা নেই মিঠাই ওকে বাদে কারো সাথে আলিঙ্গন করতে পারবে না ,রাত কাটাতে পারবে না। যার যা নিজস্ব পছন্দ।এভাবে অনি পারে না ভাবতে। ও তো মিঠাই সম্পর্কে জানে সব। আর্য ছেলেটাও খারাপ নয়। ওরা একে অপরকে বিয়ে করবে। মিঠাইয়ের বাবা সমস্ত দায়িত্ব দিয়েছে আর্যর উপর ওদের বিয়ের । আর অনি কর্তব্য এটা ওর প্রিয় বন্ধুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে পাশে থাকা। এতদিন তো ও ছিল। কিন্তু ওরা কী করছে ওসব। অনির ভালো লাগছে না আর।

গাড়ির বনেট থেকে নেমে এলো মিঠাই ।নেমে আর্যর সঙ্গে আলিঙ্গন বদ্ধ হলো কিছুক্ষণ। অনির বুকে সামান্য ব্যথা করছে। স্থির হয়ে গেছে দৃশ্য দেখে।কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন ওর থেকে ওর চলার এনার্জি টুকু কেড়ে নিয়েছে।এবার গাড়িতে ওরা দুজন উঠে পড়লো গাড়িটা চলে গেলো ওর চোখের সামনেই।
অনি আর পারলো না বাইকটা স্টার্ট দিলো। গাড়িটা এসে থামলো শহরের সবচেয়ে নির্জন এলাকাগুলোর মধ্যে একটি জায়গায় । বিশাল বাড়ি। বাড়িটা আর্যর বুঝতে অসুবিধা হয়নি অনির। ও নেমে পিছু নিলো। ওই বাড়িতে মানুষ বলতে আর্য আর মিঠাই মাত্র আর কেউ নেই যা দেখতে পেলো। বাড়িতে প্রবেশ করতে পারলো না আর। বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো। ফোন করতে লাগলো মিঠাইকে। তিনচারবার রিঙ হবার পরেও তোলেনি মিঠাই ফোনটা। আরও কিছুবার চেষ্টা করলো। মেসেজ করলো কোথায় তুই। ফ্রি হয়ে ফোন কর। আরও কিছুক্ষণ কোনো উত্তর নেই। ভোর হতে চললো শেষবার ট্রাই করলো অনি, না সুইচ অফ ফোনটা। হয়তো প্রথমে সাইলেন্ট ছিলো পরবর্তীতে চার্জ শেষ হয়ে যাওয়ায় ফোন সুইচড অফ হয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে মিঠাই আর আর্য। অনি সারারাত সেভাবে বাইকের উপর বসে রয়েছে ।চোখে মুখে ক্লান্তি। অনি অনাথ না হলেও বেশ কয়েকবছর আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। একটা চাকরি আর লেখাপড়া লেখালেখি নিয়ে কাটিয়ে দিলো এতগুলো দিন। তাই বাড়িতে কেউ নেই ওর অপেক্ষা করার তাই ফোন ও আসেনি ওর খোঁজে।সেদিন ছিলো অনির জন্মদিন।প্রতিবছর মিঠাই রাত বারোটায় ফোন করে উইশ করে। এইবছর সেটাও হলোনা।বরঞ্চ অনি বারবার ফোন করে গেছে ওপাশ থেকে কেবল শূন্যতা উপহার পেয়েছে।

মিঠাইয়ের জামাকাপড় বেশ অগোছালো লাগছে‌ ।আর্য টিশার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে । অনি আর নিতে পারেনি। মোবাইল সুইচ অফ করে চলে আসে বাড়ি। তারপর ব্যাগ গুছিয়ে দুদিনের জন্য চলে যায় সঙ্ঘমিত্রার ফার্ম হাউসে একাই।

দুদিন পর একটা মেসেজ করবার জন্য ফোন অন করতেই ফোন আসে মিঠাইয়ের। ফোন করে প্রথমেই বকা দিলো ওকে। কেন মোবাইল সুইচ অফ। একবারের জন্যেও অনিকে জন্যদিনের উইশের কথা বলেনি। তবে বকাটা কেবল ছিলো নামমাত্র অনি বুঝতে পেরেছিলো। অথচ মিঠাইয়ের বকা বরাবর উপভোগ করে নীল। মনক্ষুন্ন হলো ওর। মিঠাই ফোন করেই আর্যর সাথে ওর বিয়ে কবে হবে কখন হবে বলে যাচ্ছিলো।ফার্ম হাউসের বাইরেটা অপূর্ব সুন্দর।চারিদিকে গাছ গাছালি। শীতের সকালে কুয়াশা ফার্মের লনে ঘাসের ওপর পরে থাকে। আর সেই শীত। মনটা যতটুকু ভালো হয়েছিল এবার কিছুটা বিরক্ত হতে শুরু করলো অনি। চিৎকার করে মিঠাইকে থামিয়ে দেয়। বলে ওঠে ” তোর বিয়ে তোর ব্যাপার। আমাকে বলার কী হলো। তুই বিয়ে করছিস না লাগাতে যাচ্ছিস আমার কী কাজ শুনে! আমার কেন সময় নষ্ট করছিস। “
ফোনটা কেটে দেয় মিঠাই। তারপরেও শান্তি হয়না নীলের মেসেজ করে জানায় ” আমি কোথায় আছি একবারও জিজ্ঞেস করেছিস ! কেমন আছি? না সেসব তো তুই জানতে চাস না। আমি বাইরে আছি দেরী হবে কিছুদিন ফিরতে। একদম বিরক্ত করবি না” ।

পরে মেসেজ এসেছিল মিঠাইয়ের জন্মদিনের শুভেচ্ছা দেরীতে জানানোর জন্য ক্ষমা চেয়েছিলো। হয়তো ফেসবুক অন করতেই দেখতে পায় অনির টাইমলাইনে অনেকের পোস্ট। তাই ওর মনে পড়েছিলো।

৪.

কফি শেষ , ঘুমঘুম লাগছে চোখে , সারা শরীর ঘেমে গেছে এসি চলবার পরেও।
হাতে কিছুটা সময় আছে এখনো ।কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে মোবাইলটা নেয় ।

সেদিনই বিকেলে ফিরে আসে অনি। তিনদিন পর আর্যকে ডেকে পাঠায় নিজের ফ্ল্যাটে। মিঠাইয়ের বন্ধু হবার সুবাদে আর্য চেনে নীলকে ভালো করে ।সে আসে অনি ফ্ল্যাটে। অনি সেদিনের ঘটনা ভুলতে না পেরে আর্যকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ শুরু করে । দুজনের মধ্যে শুরু হয় তুমুল বাকবিতন্ডা। রাগের বশে আর্য বলে ওঠে মিঠাই আমার আর ও আমাকে ভালোবাসে শুধু ,তুই কে!।
মাথা ঠিক রাখতে না পেরে টেবিলের উপরে রাখা সাদা কারুকার্য করা ফুলদানিটা মেরে দেয় অনি আর্যর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। মেঝেতে পড়ে যায় শরীরটা। অনি খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে পড়ে সোফায় । অনি জানে আর্য মিঠাইকে বলে আসেনি এখানে আসার কথা। তাই মিঠাই জানেনা ।আর এই ফ্ল্যাটে কেউ দেখেনি আর্যকে আসতে। আর্যর মৃতদেহটার সামনে তাড়াহুড়ো করে এসে বসে অনি। নাকের সামনে আঙুল ধরতেই বুঝতে পারে আর্যর প্রাণপ্রদীপ নিভে গিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ ঘরটা নিস্তব্ধ। একটা পিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। শহরে তখন অন্ধকার নেমেছে ।আর্যর বডিটা টেনেটুনে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কিছুদিন আগে এই বিছানাতেই সঙ্ঘমিত্রার মৃতদেহ শুইয়ে রেখেছিলো ।আজ আবার আর্য। কেবল তো ভালোবেসেই সবটা।

দূরে আলোয় চকমক করছে বিল্ডিং, রাস্তাঘাট ।কতলোক হয়তো এভাবে প্রাণ হারাচ্ছে সামান্য কথায় । কেউ জানছে না কেউ দেখছে না।কতমানুষ ভালো বন্ধুত্বের মুখোশ পরে ঘুরছে।অথচ বোঝবার উপায় নেই।

৫.
নীরবতা খান খান করে ভেঙে বেজে উঠলো অনির মোবাইলটা আবার। দেখে আবার একটা মেসেজ মিঠাইয়ের।

” বাবু রাগ করিস না, জন্মদিনের শুভেচ্ছা এত দেরীতে বলে কথা বলছিস না! জানিস তো আর্যর নম্বরটা দুদিন ধরে সুইচ অফ, কোথাও খোঁজ পাচ্ছি না ওর। তুই বলছিস তুইও শহরে নেই। আমার একা লাগছে খুব কান্না পাচ্ছে। আমার মন ভালো করতে পারে না আর্য ,তুই একমাত্র পারিস এমন সব কথা বলে ঠিক করতে। আর্য ঠিক আসবে জানি কিন্তু তুই কথা বলবিনা? এতদিন কেউ রাগ করে থাকে? কষ্ট হচ্ছে খুব অনি,কোথায় তুই এখনই আয় ,আই অ্যাম সরি ফর এভরিথিং ফর দোজ আই টোল্ড ইউ।ইউ নো মি বেটার।”

অনির চোখটা জলে ভরে উঠলো। সিগারেট ধরিয়ে টাইপ করলো –

” হোয়াটসাপে দেখ ,কিছু ছবি পাঠিয়েছি। ,আই অ্যাম সরি ফর এভরিথিং, বাবু তুই তো জানিস ভালো করে আমি তোর কষ্ট দেখতে পারিনা । আমার ভালো লাগে না তোর মুড অফ।কিন্তু জানিস তো তুই আমাকে আগের মতো বকাবকি করিসনা আজকাল ,জন্মদিনে উইশ করিসনি খুব খারাপ লেগেছিল ।যাক গে ওসব বাদ দে। আমি বাড়িতেই আছি , পারলে আধ ঘন্টার মধ্যে চলে আয় বাড়িতে । তোর জন্য দুটো স্পেশাল গিফ্ট আছে। “

এক পাতা কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়েছে নীল , চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে, কোনোরকমে পাশে রাখা চাকুটা দিয়ে হাতের শিরার উপরে সরাসরি টেনে দিলো। মুখে প্রশান্তির হাসি।
আর বিড়বিড় করে বলছে
” আমি তো তোকে হাসিখুশি দেখতে চেয়েছিলাম ,চেয়েছিলাম তুই ভালো থাক। কিন্তু দেখ এই একসপ্তাহে কতকিছু হয়ে গেলো, আমি তোকে আজীবন হাসানোর দায়িত্বটা পালন করতে পারলামনা ।বিনিময়ে কাঁদিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। গিফট শুনলে তুই তাড়াতাড়ি আসবি জানি তুই গিফট পেতে ভালোবাসিস। হোয়াটসাপে নিশ্চয় এতক্ষনে দেখে ফেলেছিস আর্যর দেহটা আমার বিছানায় সুন্দর করে শোয়ানো আছে দেখ। ক্লান্তি নেই ওর কোনো আর।আমারও কষ্ট নেই আর। তোর জীবন থেকে আরেকজন ক্ষতিকর মানুষকে সরিয়ে দিলাম। আমি তোর খারাপ করিনি ভুল বুঝিসনা। আমরা দুজনেই যখন থাকবো না তুই তখন বুঝতে পারবি। আমি খুনি নই সবটা রাগের বশে অনিচ্ছাকৃত। আজ তুই ক্ষমা চেয়েছিস আমার কাছে প্রথমবার। আমি খুশী,আমি খুব খুশী। আজকের দিনটা কোনোদিন তুই ভুলতে পারবি না জন্মদিন ভুলে গেলেও , হ্যাপি বার্থডে টু মি , হ্যাপি বার্থডে টু…”

সূর্য ডুবছে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশ রক্তবর্ণ , ডোবার আগেই আরেকটি প্রদীপ কেবল নিভে গেলো না পাওয়ার অজুহাতে।শরীরটা পড়ে গেলো মেঝেতে হাতের শিরা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সূর্য ডোবার রঙ…

…………….. অনিমেষ সরকার