সাহিত্যে নোবেল জয় ব্যাপারটা যেন অপ্রত্যাশিত। কন্ট্রোভার্সি আর কন্ট্রোভার্সি। ডন ডেলিলো, হারুকি মুরাকামি কে ছেড়ে বব ডিলান? সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার! নাহ্, এ নামটা শুধু অপ্রত্যাশিতই ছিল না, অনেকটা অনুচ্চারিতও ছিল।
নোবেল কমিটি ডিলানের পক্ষে একটা যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন, কারণ কমিটিও জানতো, এই পুরস্কারের পক্ষ এবং বিপক্ষ নিয়ে নানা রকমের তর্কবিতর্কের সৃষ্টি হবে। তাই পুরস্কার ঘোষণার পূর্বে নোবেল দেয়ার শুধু যোগ্যতার ব্যাখ্যাই না, কেন গীতিকার শিল্পী বব ডিলান—সে পক্ষেও যুক্তি দেখিয়েছেন। আর সেসব যুক্তি কিন্তু একেবারে ফেলনা নয়। মনে রাখা যেতে পারে—সাহিত্যের প্রথাগত সীমানা ও ঐতিহ্য ভেঙে নোবেল কমিটি একটা দুঃসাহসী কাজ করেছে, এবং করেছে বলেই কিন্তু এর ফলে সঙ্গীতও তো সাহিত্যের মর্যাদার একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে!
কী বলে নোবেল কমিটি? আমেরিকার গীত ঐতিহ্যে বব ডিলান একটা কাব্যিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এটাই তো? না, আরও আছে। ডিলান তাঁর গানে অসাধারণ সুরের মূর্ছনা দিয়েছেন, দিয়েছেন দারুণ সব চিত্রকল্প। তাহলে চিত্রকল্প (অবশ্য কবিতার প্রাণ যদি থাকে, তবে তা অবশ্যই চিত্রকল্প) আছে বলেই গান কবিতা হয়ে উঠল। বলা বাহুল্য, ভালো কবিতা কিন্তু ভালো একটা গানও। সেই হিসেবে একটা ভালো গান ভালো কবিতা হবার দাবী রাখে। কথাটা সোজা করে বললে দাঁড়ায়, ডিলানের গান কাব্যিক বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বিধায় তিনি একজন কবিও। অবশ্য কমিটি ডিলানকে কেবল একজন ‘কবি’ নয়, একজন ‘মহান’ কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
শুধু তা-ই নয়, তুলনার মাত্রা আধুনিক সাহিত্য ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছে ক্ল্যাসিক সাহিত্যেও। বলা হচ্ছে, তিনি হোমার ও স্যাফো-র চাইতে কোন অংশে কম নন! ইংরেজ সাহিত্যে তিনি হচ্ছেন একজন হোমার, একজন স্যাফো, ‘যাকে পাঠ করা যায়’, ‘যাকে পাঠ করা উচিত’। তার মানে কি এটাই দাঁড়াচ্ছে না যে, ঔচিত্যের ঘাড়ে চড়ে জেনে আসতে হবে, তিনি নোবেল পাওয়ার যোগ্য, তাঁকে নোবেল দেওয়াটা কিছুমাত্র অতিরঞ্জন নয়? সেটা অবশ্য বলাও হচ্ছে না। বরং তিনি বিশদ পঠিত না হলেও, ব্যাপকভাবে শ্রুত। তাঁর গান এ প্রজন্ম শোনেনি, এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। তাঁর গান চেতনার ভিতরে গিয়ে কাজ করে। মনে যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি মস্তিষ্ককে ভাবায়। যে লেখাগুলো মানুষকে ভাবায়, তার একটা সাহিত্যমান আছে বৈকি! সেটা ডিলানের গানেও আছে। অতএব, তিনি কবি, তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। নোবেল কমিটি হয়তো এই কথাগুলোই বলতে চেয়েছে।
কিন্তু প্রথাবিরোধী যে কোন কাজই প্রথম প্রথম একটা বেশ শক্ত ধাক্কা খায়। বব ডিলান-এর ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এবং সেটা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় তো লাগবেই! নোবেল কমিটি সেটা জানে, এবং স্বীকারও করেছে। সুইডিশ এ্যাকাডেমির স্থায়ী সচিব সারা দানিয়ুস বলেই ফেলেছেন—ডিলানকে নোবেলের জন্য নির্বাচন করাটা একটা চমক মনে হতে পারে। তিনি নিজেও তার কিশোরবেলায় ডিলানভক্ত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি তাঁর ফ্যান।
ডিলানের নোবেল জয় যে সর্বসম্মত ছিল না, তা তো খোদ সাংস্কৃতিক সম্পাদক উইম্যানও স্বীকার করেছেন। পুরস্কার ঘোষণায় এতগুলো দিন কেন লাগল, সেটার কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেই ফেলেছেন যে, নির্বাচকমণ্ডলি বিজয়ী নির্বাচনে একটা সুনির্দিষ্ট ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি বলেই পুরস্কার ঘোষণা করতে এত দেরী হলো। তবে তাঁর রচিত গান যে বিশ্বসাহিত্যের একটা বিশাল উপাদান, সে বিষয়ে সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।
কাজেই বলা যায় হয়তো, গান লিখলেও তিনি একজন কবির স্বীকৃতিই পেয়েছেন পক্ষান্তরে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে তাকে নিয়ে সমালোচনা খুব একটা বেশি করা যায় না। আগেই বলা হয়েছে, কবিতা যেমন গান হয়ে উঠতে পারে, তেমনি গানেরও কবিতা হয়ে উঠতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, যদি সে ছন্দ সুরের পাশাপাশি কবিতার আর সব গুণগুলোকে ধারন করে। গান-কবিতার এই তার্কিক যুদ্ধে না জড়িয়ে বরং দেখা যাক, ডিলানের গান কী কী কাব্যিক গুণে গুণান্বিত। গানগুলোতে উপমা আছে, আছে উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্পও। এসব কিছু যুক্ত হয়ে তার গানগুলোকে কবিতারূপী করেছে।
ডিলানের গানগুলো, বলতেই হয়, প্রথাগতভাবে লেখা নয়। সেগুলোতে কাব্যিক গুণ আছে, সেটা তো নোবেল কমিটি স্বীকার করেই নিয়েছে, এবং সেটা সত্য। তাহলে এ বিষয়ে আর বোধ হয় বিতর্ক থাকে না যে তার গানগুলো কেবলই সুরের খেয়ালে বন্দী কিছু কথামালা। বরং সেগুলোকে সুর না করে পড়তে গেলে কবিতা-ই মনে হয়।
তিনি তাই গীতিকার হিসেবে যতটা না স্বীকৃতি পাওয়া উচিত, তারচে বেশি পাওয়া উচিত কবি হিসেবে, কারণ, কবিদের লেখা গান ব্যবসায়িক গীতিকারদের চাইতে অনেক বেশি গ্রাহ্য। তাঁর গানে আছে সাহিত্যমান, ঠিক একইভাবে আছে জীবনের সূক্ষ্ম বিষয়াবলি নিয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ। তিনি যখন বলেন—
খুব সামান্য শব্দও শুনতে শিখেছি আমি—দরজা আঁটার শব্দ, গাড়ির চাবির ঠোকাঠুকি। গাছের পাতা দিয়ে বাতাস চলে যাওয়ার শব্দ, পাখির গান, লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ, গরুর হাম্বা ডাক—এসব নিত্যদিনের শব্দ। আমি এসব শব্দ এক করে একটি গান বেঁধে দিতে পারতাম। ফলে জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে শুনতে পেয়েছি আমি।
তখন আমরা একজন কবিকেই দেখি। একজন কবিই পারেন উপেক্ষিত অথবা সর্বজন অগ্রাহ্য বিষয়গুলো কলমের আগায় এনে সরব করে তুলতে। বব ডিলানও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নন। তিনিও জীবনের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে জীবন্ত করেছেন তাঁর লেখনি দিয়ে। বিশেষ করে তাঁর শেষের দিকে লেখা গানগুলো ভীষণ জীবনসঞ্চারী। কল্পচিত্রের ক্ষেত্রেও তাঁকে উদ্ধৃত করা যায়—‘আমার মনের ভেতর পুরো ভূ-দৃশ্যটা ছিল। আমি লিখে গেছি। বুঝে গেছি, আমি হয়তো তুখোড় রক-এন-রোলার হতে পারব না, কিন্তু তুখোড় গীতিকার হতে পারব।’ অতএব শিল্পী হওয়ার আগে তিনি একজন গীতিকার, যাঁর গানগুলো কবিতার মতোই তীব্র, কবিতার মতোই ঘন আর চিন্তা-উদ্রেককারী। আর এজন্যই ‘মূলধারার শিল্পী’ নন বলে তিনি নিজেই তাঁর এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন।
বব ডিলানকে সাহিত্যে পুরস্কার দেয়াটা খুব সহজ কাজ ছিল না। তিনি সঙ্গীতের মানুষ। একজন সঙ্গীতজ্ঞ এই প্রথম সাহিত্যে নোবেল পাচ্ছেন (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেয়েছিলেন এই জন্য না যে তিনি একজন গীতিকার, কিংবা এজন্যও না যে তিনি গীতাঞ্জলি-ও অনুবাদ করেছিলেন গীত হবার জন্য। বরং তাঁর সঙ্স অফারিংস ছিল গীতাঞ্জলির কিছু অংশমাত্র, পুরোটা না।)। নোবেল কমিটিকে তাই একটা যুক্তি দাঁড় করাতেই হয়েছে। যুক্তির গ্রাহ্যতার মোড়ক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ডিলানের লিরিক। কমিটি তাই তাঁর রচিত লিরিক নিয়েই কথা বললেন—ডিলানের গানগুলোর নতুন নতুন সংস্করণ বের হয়েছে নিয়মিতভাবে। তাঁর লেখার সংকলন ছাড়াও বের হয়েছে একটা নিরীক্ষাধর্মী গ্রন্থ ট্যারান্টুলা ও আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ক্রোনিকল্স। কমিটি তাঁকে দেখিয়েছেন বহুমুখী প্রতিভা হিসেবে। তিনি যে শুধু গান গেয়েছেন, তা-ই নয়। তিনি প্রতিভা ছড়িয়েছেন চিত্রকলায়। করেছেন অভিনয় আর লিখেছেন সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট। এত কিছু করে ডিলান একজন আইকন-এ পরিণত হয়েছেন। সমসাময়িক সঙ্গীতে যেমন রয়েছে তাঁর গভীর প্রভাব, তেমনি সাহিত্যে রয়েছে চলমান ধারাবাহিকতা।
স্যার এ্যান্ড্রু মোশনসহ অনেক কবিই তাঁর এই পুরস্কারকে সমর্থন করে বলেছেন, ডিলানের গান কবিতার মতই। কবিতার মতোই এগুলোতে আছে ‘শ্রেষ্ঠতম শব্দসমূহের সর্বোত্তম বিন্যাস’। আর তা-ই যদি হয়, কবি হিসেবেও কিন্তু তিনি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।
বব ডিলান-এর জন্ম ২৪ মে ১৯৪১, মিনেসোটায়। তাঁর আসল নাম রবার্ট এ্যালেন জিমারম্যান। কিন্তু কবি ডিলান টমাস-এর নামে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ডিলান নামটা গ্রহণ করেন। এই নামেই স্টেজে ওঠেন তিনি। শুরু হয় লোকসঙ্গীত নিয়ে তাঁর যাত্রা। কিন্তু নিজেকে রাখলেন প্রথাগত ধারনার বাইরে। সেজন্য গ্রহণযোগ্যতা খুব সহজেই তাঁকে ধরা দেয়নি। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে যে গিটারকে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন, নানান প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেও সেটাকে তিনি ৫৪ বছর একটানা বয়ে বেড়িয়েছেন। এখন এই গিটারই তাঁর নিত্যসঙ্গী। আর এই গিটার-ই তাঁকে এনে দিল সাহিত্যের নোবেল। কিন্তু সেটা বিতর্ককে ছাড়িয়ে গেল না। না গেলেও ডিলানের কিছু যায় আসে না। তাঁর অবস্থান এখন সেইখানে, যেখানে পৌঁছালে মানুষ অসাধরণ হয়ে ওঠে, যেখানে পৌঁছালে পার্থিব যে কোন পুরস্কার তাঁকে স্পর্শ করার যোগ্যতা হারায়। নোবেল কমিটি ডিলানকে পুরস্কার দিয়ে তাঁকে কোন উচ্চতা এনে দেয়নি, বরং কমিটি নিজে পৌঁছে গেছে অনেক উপরে। সঙ্গীতের একজনকে সাহিত্যের পুরস্কার দিতে গিয়ে তাদের মধ্যে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করেছে, সেজন্য দেরীও হয়েছে পুরস্কার ঘোষণা করতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এই সিদ্ধান্ত তাদের কর্মপরিধিকে যেমন ব্যাপকতা দান করল, তেমনি সমালোচিত হবার একটা সুযোগও করে দিল। পরবর্তী প্রজন্ম সে সুযোগটাকে কোন্ খাতে কীভাবে ব্যয় করবে, সেটা সময়ের বিচার। কিন্তু সময় এক সময় স্বীকৃতি দিবে, বলবে, ডিলানকে পুরস্কৃত করার আজকের এই সিদ্ধান্তটা সত্যিকার অর্থেই খুব সময়োপযোগী, আর সেটার যে কোন বিকল্প নোবেল কমিটিকে পিছনে ঠেলে দিত বহুগুণ।
………………………….ঋতুরাজ সরকার