দশভুজা দুর্গার যে মূর্তি ‘গন্ধর্বনারায়ণের বংশাবলী’তে কল্পনা করা হয়েছিল, ঐ মূর্তি ধাতুময় হয়ে কোচবিহারের মদনমোহন মন্দিরের সংলগ্ন ভগবতী মন্দিরে স্থাপিত রয়েছে।জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর রাজ এস্টেটের রাজবাড়ির অন্দরমহলে আজও নিত্য পূজিতা হচ্ছেন একই মাতৃমূর্তি।মণ্ডপে যে দশভুজা দুর্গোৎসবের সময়ে আরাধিতা হন, কালের নিয়মে ও আধুনিক যুগের চাহিদায় তা পরিবর্তিত হয়েছে সত্য, ড:চারুচন্দ্র সান্যালের লেখায় তা আংশিক প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
আমার ‘রায়কত বংশের রাজর্ষি’ বইটিতে ছবির অ্যালবামে আমি ২০০৩ সালে কোচবিহার ও বৈকুন্ঠপুরের প্রাচীনতম দুর্গামূর্তির ফটোকপিটি ছেপেছিলাম।
এছাড়াও ২০০২সালে রাজবাড়ির কর্ণধার প্রণতকুমার বসু এবং তদীয় স্ত্রী স্বপ্না বসুর (বর্তমানে প্রয়াতা)সঙ্গে আমি জোড়পাকুড়ি দক্ষিণ পূর্বে খয়েরখাল নামক স্থানে নবমী পুজোর দিন অনুরূপ স্বর্ণ দুর্গার মূর্তি দেখতে গিয়েছিলাম। ঐ তিনটি মূর্তির আকৃতি ও প্রকৃতি একই রকমের।উচ্চতা ১০ ইঞ্চির বেশি নয়।
১৫১০ সালে শিশু ও বিশু নামে হরিয়া মণ্ডলের দুই সন্তান সাবালকত্বের দোরগড়ায় চিন্ময়ী মাকে ইচ্ছে মতো মাটির ঢেলা দিয়ে মৃন্ময়ী জ্ঞানে প্রথম পুজো করেছিলেন, নরবলি দিয়েছিলেন বল গেইট সাহেব লিখেছিলেন, ঐ দুর্গামূর্তি কিন্তু দশভুজা ছিলেন না।থাকা সম্ভবও ছিল না। তাই আমরা ঐ অমূর্ত মূর্তির বিষয়টি উল্লেখ করলাম মাত্র।
এবার আসি সাকারা দেবীমূর্তি প্রসঙ্গে।জলপাইগুড়ির গৃহদেবতা বৈকুন্ঠনাথ ও দশভুজা মা দুর্গা অন্দরে একই আসনে প্রতিঠিতা হয়ে নিত্য পূজিতা হয়ে থাকেন।দশভুজার ডান দিকের হাতগুলোতে শূল,শর,শক্তি,চক্র, শোভা পায়। বাম হাতগুলোতে শোভিত আছে পাশ,খেটক,ধনু,কুঠার ও অঙ্কুশ।দেবী ডান হাতে শূল ধারণ করে অসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছেন।মহিষের কাটা গলা থেকে অসুরের জন্ম। অসুরের বাম বাহু কামড়ে ধরেছে বাঘ।সিংহের উপরে স্থাপিত দেবীর দক্ষিণ চরণ।দেবী নানা অলংকারে ভূষিতা। মাতৃমূর্তির মুখমণ্ডল ডিম্বাকৃতি এবং চোখদুটি কোটরগতা ও ভীষণা।তৃতীয় নেত্র স্পষ্ট হয়ে আছে।মায়ের মাথার কেশদাম চূড়াবদ্ধ।অসুরের বামগণ্ড ও বামচোখ দৃশ্যমান।দৃশ্যমান তার উদার বিস্তৃত বক্ষদেশ। তার ডান পা গোটানো কিন্তু বাম পা টি ছড়ানো। হাতে দৃঢ় ভাবে ধরা আছে খাপে আধো খোলা তরবারি।সিংহটি অসুরের দক্ষিণ বাহুমূল আক্রমণ করেছে এবং বাঘটি অপর বাহুমূল কামড়ে ধরেছে।উভয় বাহুমূলই রক্তাক্ত।মূর্তির বেদীটি বিস্তৃত ও তাম্রপাত্রে আচ্ছাদিত।অসুরের মাথায় মুকুটের পরিবর্তে পাগড়ি লক্ষ্য করা যায়।
গন্ধর্বনারায়ণের বংশাবলী বর্ণিত মূর্তির সঙ্গে জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির দুর্গামূর্তির একটু পার্থক্যও আছে।ঐ পার্থক্য হল দেবীর হাতে ত্রিশূলের পরিবর্তে শূল বা বল্লম জাতীয় একটি অস্ত্র এসে অসুরের বক্ষদেশ আঘাত করেছে।দ্বিতীয় পার্থক্যটি হল মহিষের ছিন্নমুণ্ড বেদীতে রক্ষিত।মহিষের কাটামুণ্ড থেকে অসুরের উৎপত্তি বিষয়টি দৃশ্যমান নয়।
আধুনিক মূর্তিতে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী কলাবউ যেমন আছে, তেমনি আছে ব্রহ্মা,বিষ্নু,মহেশ্বর।দেবীর ডানদিকে জয়া এবং বাম দিকে বিজয়া বিরাজমানা।মহামায়ারূপী মেছেনী মূর্তি এখন রাজবাড়ির পুজোর প্রধান আকর্ষণ।৫১১ বছর ধরে উত্তরের দুর্গাপুজোর আনন্দে এবার প্রধান বিভীষিকা করোনা অতিমারী।
…………………… উমেশ শর্মা