জীবিত অবস্থায় স্বীকৃতি না পাওয়া বহু কিংবদন্তি শিল্পীদের কথা আমরা জানি, তাদের মধ্যে ভিনসেন্ট ভ্যান গগ অন্যতম। এই চিত্রকার নিজের কীর্তিগাথার জয়জয়কার কিছুই নিজে দেখে যেতে পারেননি। তার আগেই তিনি অবসাদে আত্মহত্যা করেন। শুধুমাত্র আঁকার জন্যই তিনি বিখ্যাত ছিলেন না , তিনি তাঁর বাস্তব জীবনের কঠিন লড়াইয়ের জন্যও পরিচিত ছিলেন। বিষণ্ণ এই জাদুকর বুক ভরা বিষাদ নিয়েও শিল্প সংস্কৃতিকে বেশকিছু শ্রেষ্ঠ উপহার দিয়েছেন। আজ আমরা এই কৃতী শিল্পীর সম্পর্কে বেশকিছু অজানা অজানা তথ্য জানব।
তিনি তাঁর পরিবারে একমাত্র ভিনসেন্ট ছিলেন না। তাঁর বড় ভাই ও পিতামহ উভয়ের নামও ছিল ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। ছোট ভাই থিও ভ্যান গগ ভাইয়ের স্মরণে নিজের ছেলের নাম রাখেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ।
২৭ বছর বয়সে প্রথম ছবি আঁকা শুরু করেছিলেন তিনি। ছবি আঁকার জন্য কারো কাছে পেশাদারী প্রশিক্ষণ নেননি তিনি। শুরুর দিকের ছবিগুলোতে খুব একটা রঙ ব্যবহার করতেন না তিনি। সমাজের নিদারুণ বাস্তবতা আয়নার মত ফুটে উঠত তাঁর তুলি ও ক্যানভাসে। অতিদরিদ্র জীবনযাপন মূলক দৃশ্য ফুটে উঠত তাঁর ছবিগুলিতে। পরবর্তীতে তাঁর ছবিগুলোতে রঙের ব্যবহার অনেকাংশে বেড়ে যায়, এবং মূলত সেই ছবিগুলোর জন্যই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন ভিনসেন্ট।
আরেক বিখ্যাত চিত্রকার পল গাউগুইনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন ভিনসেন্ট।প্যারিসে তাদের প্রথম সাক্ষাত ঘটে ও সেই থেকে এই দুজনে একসাথে অনেক ছবি এঁকেছেন। যদিও দুজনের আঁকার ধারা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজের ভাই থিও ভ্যান গগকে লেখা এক চিঠিতে ভিনসেন্ট জানিয়েছিলেন, তার আঁকার জগতে পলের অবদান অপরিসীম। ভিনসেন্টকে মুক্ত চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন পল, যা চিত্রকার হিসেবে তাকে আরও স্বীকৃতির দরবারে ঠেলে দিতে সাহায্য করে।
বহু তর্কের সাপেক্ষে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের আঁকা শ্রেষ্ঠ ছবিটি স্ট্যারি নাইট। তবে আশ্চর্য ব্যাপার হলো এই ছবিটি ভিনসেন্ট এঁকেছেন একটি আশ্রমে বসে। নিজের কাটা কান নিয়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লে তিনি স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের একটি আশ্রমে আসেন । বলা হয় ছবিটি ছিল ভ্যান গগের বিছানার পাশের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া রাতের দৃশ্য। ১৯৪১ সাল থেকে এই ছবিটি মেট্রোপলিটন আর্টস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিভিন্ন অজানা দিক উঠে এসেছে এই ছবিটির মাধ্যমে। ভিনসেন্টের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন তার ছোট ভাই থিও ভ্যান গগ, পল গাউগুইন ও আরেক চিত্রকার এমিলি বারটান্ড। নিজেদের মধ্যে প্রচুর চিঠি আদান-প্রদান করতেন তারা। জীবদ্দশায় প্রায় ৮০০ টি চিঠি লিখেছেন ভ্যান গগ। এই চিঠিগুলোই সাহায্য করেছে পুরো বিশ্বকে ভ্যান গগ সম্পর্কে জানতে।
তবে সেই চিঠিগুলোর অধিকাংশই তিনি লিখেছিলেন তাঁর ছোট ভাই থিওকে। থিও ভ্যান গগ সবগুলো চিঠিগুলি যত্নসহকারে রেখে দিতেন। এই চিঠিগুলোতে নিজেদের বন্ধুত্ব, ভিনসেন্টের শিল্পীভাবের চিন্তাধারা ও জগতের ধারণা পাওয়া যায়। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর সবগুলো চিঠি সংগ্রহ করেন থিওর স্ত্রী জোয়ানা ভ্যান গগ। তারই সাহায্যে সেইসব চিঠিগুলো পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়।
ভিনসেন্টের আঁকা সবচেয়ে দামী ছবিটি হচ্ছে ‘পোরট্রেইট অফ ডক্টর গ্যাচেট’। ১৮৯০ সালে তিনি এই ছবিটি এঁকেছিলেন এবং তার ঠিক একশ বছর পর ১৯৯০ সালে সেই ছবিটি নিলামে ওঠে এবং সেই সময়ে ছবিটি বিক্রি করা হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে, যা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ছবিগুলোর মধ্যেও একটি।
৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় হওয়া ছবি থাকলেও নিজের জীবনে পুরোটা সময়ই দরিদ্রতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো ভ্যান গগকে। সত্যিকার অর্থে জীবদ্দশায় মাত্র একটি ছবিই বিক্রয় করতে পেরেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। রেড ভাইনইয়ার্ড নামের ছবিটিই ভিনসেন্টের নিজ হাতে বিক্রয় করে যাওয়া একমাত্র ছবি। আত্মহত্যা না করে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো নিজ চোখেই নিজের কীর্তির সম্মাননা দেখে যেতে পারতেন এই কিংবদন্তি।
জীবনের বড় অংশে জুড়েই ভ্যান গগ মানসিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন। বিভিন্ন মানসিক হাসপাতালে দিন কাটিয়েছিলেন এই স্বনামধন্য চিত্রকার। পরবর্তীতে জানা যায় দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা, মানসিক ভ্রান্তি জীবনের পুরাটা জীবন কাটিয়ে ছিলেন তিনি। আধুনিক সাইকিয়াট্রিস্টদের ধারণা তিনি স্কিৎজোফ্রেনিয়া, সিফিলিস, মৃগী রোগ ছাড়াও বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলেন। এছাড়াও টাকার অভাবে খাদ্যাভাবের জন্যও বেশ দুর্বল ছিলেন ভ্যান গগ। মূলত মানসিক ও শারীরিক দুভাবেই বেশ অসুস্থ ছিলেন এই চিত্রশিল্পী।
এই গুণী শিল্পী নিজের কান নিজে কেটে ফেলেছিলেন! তবে ভ্যান গগের কান কাটা নিয়ে বেশ কিছু গল্প রয়েছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় গল্পটি ছিল যে, পল গাউগুইনের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েই রেজর দিয়ে নিজের কান কেটে ফেলেন তিনি। পরবর্তীতে সেটি র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে যৌনপল্লির এক মহিলার কাছে তা পাঠিয়ে দেন, যে মহিলার নিকট ভ্যান গগ ও পল গাউগুইন দুজনেরই যাতায়াত ছিল। আরেক ভাষ্যমতে, পল গাউগুইন নিজ হাতেই ভিনসেন্টের কান কেটে ফেলেন। তবে সেই কান কাটার ঘটনার পরই পল গাউগুইনের সাথে বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে তার। তাই সবার ধারণা, কান কর্তনের সাথে পল গাউগুইন সরাসরিই জড়িত।
১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই ভিনসেন্ট ভ্যান গগ নিজের বুকে নিজেই গুলি করেন ও এর ঠিক দুদিন পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বলা হয়, একটি গম ক্ষেতে দাঁড়িয়ে তিনি নিজের বুকে গুলি চালান। গুলি করার আগ মুহূর্তে গমের ক্ষেতে বসেই ছবি আঁকছিলেন তিনি। গুলি করার পরেও তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে নিজ বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে তাকে দুজন ডাক্তার দেখভাল শুরু করেন, কিন্তু দুদিন পর ২৯ জুলাই তিনি পরপারে পাড়ি দেন। ছোট ভাই থিও ভ্যান গগের মতে, তাঁর জীবনের শেষ বাক্যটি ছিল ‘লা ত্রিসতেসে দুরেরা তৌজুরস’, যার ইংরেজি অর্থ ‘This sadness will last forever’।