নিষেধ করেছিলেন অনেকেই, শোনেন নি ফাদার দেসগোদিনস, ফ্রেঞ্চ ফাদার অগাস্টিন দেসগোদিনস ( ফরাসী ভাষায় যদিও “দেগোদে”। তা যাই-হোক, আমি তো অবশ্যই তার নামের বাংলাকরণই করবো, কারণ তিনি এসেছিলেন তো বঙ্গদেশেই, শেষ জীবনও কাটান বঙ্গদেশেই, তা সে যেখান থেকেই আসুন না কেনো) । অনেকের আপত্তি স্বত্বেও প্রায় জোর করেই রওনা দেন তিব্বত। সিল্ক রুট ধরেই যাত্রা, নাথুলা পার হয়ে তার মিশনারী দল নিয়ে পৌঁছে যান তিব্বত, উদ্দেশ্য খ্রিষ্টধর্মের প্রচার। বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান তিব্বতের লামারা যে বিষয়টাকে খুব হালকা ভাবে নেবে না, সেটার আঁচ পেয়ে যান পৌঁছানোর মুহূর্তেই। কিন্তু ফাদার দেসগোদিনস নিজ সিদ্ধান্তে অটল, ধর্ম প্রচারের গুরু দায়িত্ব যে তিনি স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে। বহু প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি এগিয়ে চলেছেন এতো বছর। তাই-ই হয়তো এতবড় দায়িত্ব সঁপা হয়েছে তারই ওপর। প্যারিসের ফরেইন মিশন সোসাইটি যে ক্ষমতা পেয়েছিল স্বয়ং পোপ গ্রেগরি ষোড়শের থেকে সেই ক্ষমতা বলেই তিব্বতে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের কাজে নিযুক্ত করা হয় ফাদার দেসগোদিনসকে। সালটা ১৮৮০।
তবে এবার আক্রমণ যে এতো তাড়াতাড়ি ধেয়ে আসবে আর তার হিংস্রতা যে এতটা ভয়ানক হবে, তা ঠাওর করতে পারেন নি ফাদার। সেই রাতে হাজার মশাল হাতে অজানা শত্রুরা ধেয়ে আসে তাদের অস্থায়ী তাঁবুর দিকে। মুহূর্তে তছনছ হয়ে যায় সব। মাথায় প্রবল আঘাতে জ্ঞান হারান ফাদার। যখন জ্ঞান ফেরে তখন লোকালয় থেকে অনেক দূরে এক শুয়োরের খোঁয়াড়ে মাটি চাপা অবস্থায় পড়ে আছেন তিনি। শরীরে সার বলতে কিছু নেই। দলের কাউকেই আর খুঁজে পাননি আশেপাশে। নিজে স্থানীয় এক দয়ালু গ্রাম্য পাহাড়ী মহিলার সাহায্যে কোনমতে পথহীন অজানা পাহাড়ী ঢাল বেয়ে পালাতে থাকেন দক্ষিণ দিকে। রাত জেগে জঙ্গল পাড়ি দেন, দিনে জঙ্গলেই পড়ে থাকেন ঘাপটি মেরে। দু-তিন রাত এইভাবে চলার পর বুঝতে পারেন তিব্বত পেরিয়ে এসেছেন অনেক আগেই, অনেকটা নেমে এসে পৌঁছেছেন ভারত-ভুটান সীমান্তের অদ্ভুত এক নৈসর্গিক পরিবেশে, এক লেপচা প্রধান গ্রামে। স্বভাববশতঃ সিদ্ধান্ত নিতে এখানেও দেরি করেন নি তিনি, স্থাপন করেন পেদং-এর প্রথম রোমান ক্যাথলিক চার্চ। তবে তার এবারের সিদ্ধান্তে যে কোন ভুল ছিল না তা দেখতে যখন তখন আসা যেতে পারে পেদং-এ। বর্তমান কালিম্পং জেলার উত্তর সীমানা ছুঁয়ে মেঘের রাজ্যে অবস্থিত এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা – পেদং। যার চূড়ায় ড্যামসং ফোর্ট, পদতলে ঋষি নদী, মাঝে পাকদণ্ডীর পর পাকদণ্ডী। তবে সে পাকদণ্ডী ততটাও খাড়া নয়, বরং মসৃণ। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র জিগজাগ ভ্যালি এই পেদং। সবুজে মোড়া মায়াবী উপত্যকা যেন হাতছানি দিতে থাকে অবিরত।
সে যাই হোক, আবার ফিরে যাই গল্পে। তা, চার্চ নির্মাণ করে ফাদার দেসগোদিনস তো পেদং-এ থিতু হলেন ঠিকই, কিন্তু তিব্বতের সেই ভয়ংকর স্মৃতি তাকে কুরে কুরে খায় রোজ। বিশেষ করে তার মিশনারী দলের সদস্যদের কথা ভেবে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না রাতে। তাদের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম তো দূরের কথা, তাদের পরিণতির কথাই জানেন না তিনি। ওনাদের আপত্তি স্বত্তেও প্রায় জোর করেই ওদের নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, এই অনুশোচনা তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। এভাবেই কাটছিলো দিন। দিনের বেলা ধর্মপ্রচার, আর দরিদ্রের সেবা। তারপর রাত জেগে থাকা পাপের ভাগীদার হয়ে। তখন ১৮৮২, পেরিয়ে গেছে দুটো বছর। হঠাৎই একদিন প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে ফাদার পাহাড়ী পথে পৌঁছে যান এমন এক পাহাড়ের বাঁকে যেখান থেকে উত্তর-পূর্বে ধরা দেয় শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা, আর উত্তরে সরাসরি দেখা যায় নাথুলা পার করে তিব্বতের সুউচ্চ পাহাড়। উত্তরে তাকাতেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে তার, দু’চোখ বুঝে আসে অদ্ভুত এক আধ্যাত্মিক চেতনায়। আর ঠিক তখনই দৈববাণী ভেসে আসে কানে। দেরী না করে দুদিনের মধ্যে পাহাড় কেটে ফাদার দেসগোদিনস প্রতিস্থাপন করেন কাঠের বিশ ফুট উচ্চতার শ্বেতশুভ্র পবিত্র ক্রস, যা দেখা যাবে তিব্বত থেকেও। আর সেই সাথে বিধাতা পুত্র যীশুর আশীর্বাদ বর্ষিত হবে তিব্বতে হারিয়ে যাওয়া ফাদারের সেই সদস্যদের ওপরে।
সেই ঐতিহাসিক কাঠের ক্রস হয়তো আজ আর নেই, নির্মিত হয়েছে কংক্রিটের ক্রস, তবু সে আজও বহন করে চলেছে দু’শতাব্দী প্রাচীন এক মন কেমন করা ইতিহাস। আজও সে উন্নত শিরে পাহাড়ের বুক চিরে আশীর্বাদ করে চলেছে সুদূর তিব্বতে হারিয়ে যাওয়া মিশনারীদের।
বিঃদ্রঃ – সাহিত্যের প্রয়োজনে মূল ইতিহাস যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রেখে লোককথা আর কল্পনার আশ্রয় নেওয়ার জন্য লেখক ক্ষমাপ্রার্থী।
……………..কৌশিক চক্রবর্ত্তী