একটি ব্রিজ আর কিছু কথা

বিভূতি বলল,
– এটায় উঠতেই হবে!
উঠব কীভাবে? থামলে তো! নাকের ডগা দিয়ে হুঁশ করে বেরিয়ে গেল বাসটা।

চার নম্বরে রাস্তা অনেকটা বাঁক নিয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর সারি। বুঝলাম ব্রিজের জ্যাম খুলেছে।

কোচবিহারে আড্ডা দিয়ে সন্ধে নাগাদ হরিশ পাল চৌপথি থেকে বাস ধরেছিলাম। বাণী নিকেতন গার্লস স্কুলের সামনে এসে দীর্ঘ লাইন দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না, কপালে দুঃখ আছে! জানা গেল, ঘুঘুমারি রেল ব্রিজে ট্রাক নষ্ট হয়েছে। মেরামতি চলছে। কখন রাস্তা খুলবে ঠিক নেই।

এই এক ব্রিজ! সারা ভারতে এরকম আর একটিও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। রেলের হলেও এই ব্রিজ দিয়ে বাস, ট্রাক, টেম্পো, মোটর সাইকেল, স্কুটার, রিক্সা, ঠ্যালা সব চলে। এটিই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র সেই রেল ব্রিজ যেখানে ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে থাকে, কখন ব্রিজটি তার চলার মতো হবে!

কোচবিহারে তখন ঢুকবার পথ এই একটিই। শিলিগুড়ি, তুফানগঞ্জ, ফালাকাটা, মাথাভাঙ্গা, দিনহাটা ইত্যাদি সব দিক থেকেই রাজনগরে পৌঁছবার এই একটিই পথ! রেল ব্রিজটি  সিঙ্গেল ওয়ে হওয়ায় বিপত্তি আরও। শহরে ঢুকতে বা বেরোতে কোনও একবার আটকে থাকতেই হবে! খুব খুব খুব কপাল ভাল হলে ব্রিজ পেরোনো যাবে দ্রুত।

কিন্তু আমার তো চিরকাল সেই কপাল। তাই সকাল বিকাল রাত মায় গভীর রাত যখনই আসি, ব্রিজ বলে ‘ধীরে যা রে বন্ধু!’ তা সেদিনও তাই। ট্রাক নষ্ট হওয়ার জন্য ব্রিজের দুদিকেই লম্বা লাইন। অগত্যা হাঁটা শুরু। হাঁটতে হাঁটতে কিমি পাঁচেক চলে আসবার পর প্রথম বাসের সঙ্গে দেখা। তিনি অবশ্য থামলেন না। দ্বিতীয় বাসটিও যখন থামল না, তখন বুদ্ধি খুলল। চার নম্বরে একটি বিকট বাম্প ছিল। দাঁড়ালাম তার সামনে। পরের বাসটি সেখানে স্পিড স্লো করতেই বাসের পেছনে ছাদে ওঠার সিঁড়ি ধরে ঝুলে পড়লাম দুজনে। বাস থামল দেওয়ানহাটে। এবার পেছন থেকে নেমে বাসের ভেতর। পয়সা বাঁচল। হু হু হাওয়ায় এতক্ষণের পরিশ্রমের ঘাম শুকিয়ে গেল!

এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের মাঝবয়েসী (নাকি বুড়ো!) প্রত্যেকেরই কমবেশি আছে। সে আমলে কোচবিহারের রেলব্রিজে আটকে থাকেনি এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না। আর সবারই টিপিক্যাল সব স্মৃতি আছে সেই আটকে থাকার। একেই রেলব্রিজ। তার ওপর গাড়ি চলছে। অর্থাৎ পিচের ওপর রেল লাইন। আর সেই রেল লাইনের গর্তে সাইকেলের চাকা ঢুকে কতজন যে ‘পপাত চ’ হত তার হিসেব ছিল না! ব্রিজের দুদিকের দুটো রাক্ষুসে গতি নিরোধক ঢিপিতে কত গাড়ির তলা যে ফেটে যেত সেটাই বা জানছে কে! সেই সময়ে ব্রিজকে আমরা প্রতিদিন গালি দিতাম। মজা হল, ব্রিজ পার হলেই কষ্ট ভুলে যেতাম মুহূর্তে!

সেই রেল ব্রিজ এখন শুধুমাত্র ট্রেনের জন্যই। বহুদিন আগেই গাড়ি চলাচলের অন্য সেতু হয়েছে। আজকের প্রজন্ম বুঝবে না কেমন ছিল সেই দিনগুলি।

আমাদের জীবনটা কি ওই ব্রিজের মতো নয়? একসময় হৈ চৈ, সবার কাজে লাগা, অন্যের বিরক্তির কারণ হলেও গুরুত্ব পাওয়া!  তারপর? পরিত্যক্ত! একা। হঠাৎ কখনও কোনও ট্রেনের মতো কারও সঙ্গে সামান্য দেখা বা কথা! বাকি সময়? নিস্তরঙ্গ। জীবন বয়ে চলবে যেমন বয়ে চলে তোর্ষার প্রবাহ। শুধু দেখে যাওয়া চুপচাপ কোনও এক জায়গা থেকে। ওই ব্রিজের মতোই….